দলপতি হিংস্র গলায় বলল, হ্যাঁ। করো। এর এই অভিশপ্ত মস্তকটাকে ছিন্নভিন্ন করে দাও।
লাল চুলের মেয়েটি তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তুলে গুলি করল। ঝলক ঝলক রক্ত বের হয়ে দেহটি ঘুরে পড়ে যাবার কথা ছিল কিন্তু দেহটি পড়ে গেল না। বরং মহামান্য থুল ওঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি তোমাদের আরো একটু বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম। তোমরা কেউ অনুমান করতে পার নি আমি যে আমি নই? আমি আমার হলোগ্রাফিক ছবি। নেটওয়ার্ক ধ্বংস হয়ে গেছে, জরুরি বিদ্যুৎ দিয়ে এই হলোগ্রাফিক ছবি তোমাদের দেখানো হয়েছে, মনে হয় আর দেখানো সম্ভব নয়। সত্যিই যদি আমাকে চাও বাইরে খুঁজতে হবে। আমি এখন বাইরে। লক্ষ লক্ষ বিভ্রান্ত আতংকিত মানুষের সাথে মিশে গেছি।
প্রচণ্ড আক্রোশে সবগুলো রবোমানব মহামান্য থুলের হলোগ্রাফিক ছবিটিকেই গুলি করতে থাকে। মহামান্য থুল হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে বইলেন। খুব ধীরে ধীরে তার ছবিটি মিলিয়ে গেল।
রাস্তার ফুটপাথ দিয়ে অসংখ্য মানুষ ছুটছে। একটা ছোট শিশু কাঁদছে আর তার মা শিশুটির হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। শিশুটি জিজ্ঞেস করল, এখন কী হবে মা? নেটওয়ার্ক ধ্বংস হয়ে গেছে–
আমি জানি না। মা ভয় পাওয়া গলায় বললেন, আমি জানি না বাবা।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বৃদ্ধ বলল, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।
মা জিজ্ঞেস করল, আপনি কেমন করে জানেন?
বৃদ্ধ হাসলেন, বললেন, আমি জানি! মানুষের অসাধ্য কিছু নেই।
আপনাকে চেনা চেনা লাগছে। আপনাকে কী আমি আগে কখনো দেখেছি?
আমি জানি না। অনেকের চেহারা হয় এরকম, দেখলেই মনে হয় আগে কোথায় জানি দেখেছি। মনে হয় আমার চেহারা সেরকম।
আপনি সত্যিই বলছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে?
হ্যাঁ। বিশ্বাস কর। আমি বলছি সব ঠিক হয়ে যাবে।
মা শিশুটিকে নিয়ে ছুটতে থাকে। শিশুটি এখন নতুন উৎসাহে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলল, মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হাসছিস কেন?
এমনি।
তোর ভয় করছে না?
না। আমার ভয় করছে না।
কেন ভয় করছে না?
ঐ যে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।
কোন বুড়ো কী না কী বলেছে—
কী বলছ তুমি মা? তুমি মহামান্য থুলকে চিনতে পার নি?
মা থমকে দাঁড়ালেন, পিছনে তাকালেন কিন্তু থুলকে আর খুঁজে পেলেন না।
২১. নীহা কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে
নীহা কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। খানিকক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থেকে সে মাথা ঘুরিয়ে ভিতরে অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ?
কী?
এই যে সামনে সুহা আর ক্লদের মৃতদেহ পড়েছিল—
হ্যাঁ। মৃতদেহ দুটি আর নেই।
তাই নাকি? টর জানালার পাশে এসে দাঁড়াল, বাইরে তাকিয়ে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। মৃতদেহগুলো কোথায়?
টুরান বলল, নিশ্চয়ই তেজস্ক্রিয় প্রাণীগুলো নিয়ে গেছে।
নিয়ে কী করবে?
জানি না। টর মাথা নাড়ল, এই প্রাণীগুলো সম্পর্কে কেউ খুব বেশি জানে না। এগুলো সত্যিকার প্রাণী না। হাইব্রিড।
নীহা বলল, আমি আর প্রাণীদের কথা ভাবতে চাই না। ট্রিনিটি বলেছে স্কাউটশিপ পাঠিয়ে আমাদের নিয়ে যাবে, আমি তার জন্যে অপেক্ষা করছি।
আমরা সবাই সেজন্যে অপেক্ষা করছি।
নীহা আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। সে কী কুগুরাভ সমীকরণের সমাধানের কথা চিন্তা করছে নাকি মঙ্গল গ্রহের নিঃসঙ্গ লাল প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে আসছে বোঝা যায় না।
ট্রিনিটি স্কাউটশিপটাকে যখন তাদের আবাসস্থলের কাছে নামিয়ে আনে তখন সূর্য ঢলে পড়ছে। ছড়ানো ছিটানো পাথরের লম্বা ছায়া চারদিকে একটি আধিভৌতিক দৃশ্য তৈরি করেছে। আবাসস্থলের ভেতরে সবাই তাদের স্পেসস্যুট পরে নেয় তারপর হাতে অস্ত্রগুলো নিয়ে বের হয়। স্কাউটশিপটি কাছেই, তারপরেও তারা দ্রুত হাঁটতে থাকে। তারা যখন স্কাউটশিপের কাছাকাছি পৌঁছেছে তখন ইহিতার কণ্ঠকর শুনতে পেল, তাড়াতাড়ি হাঁট। প্রাণীগুলো আসছে।
টর বলল, আসতে দাও। আমি এখন আর ভয় পাই না, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে একেবারে শেষ করে দেব।
ইহিতা বলল, কোনো প্রয়োজন নেই। গোলাগুলি না করে আমরা ছুটে উঠে যাই। চল।
সবাই তখন ছুটতে থাকে। স্কাউটশিপের কাছে এসে প্রথমে টুরান, তারপর ইহিতা, আর টর লাফিয়ে স্কাউটশিপে উঠে গেল। নুট যখন নীহাকে ধাক্কা দিয়ে স্কাউটশিপের ভেতরে উঠিয়ে দিচ্ছে ঠিক তখন চারপাশ থেকে প্রাণীগুলো তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করায় জন্যে ওপর থেকে টরকে এক পশলা গুলি করতে হল, প্রাণীগুলো যখন একটু সরে যায় তখন সবাই নীহাকে টেনে ভেতরে তুলে নেয়। প্রাণীগুলো তখন আবার ছুটে তাদের আক্রমণ করার চেষ্টা করে কিন্তু ততক্ষণে স্কাউটশিপের ভারী দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও বাইরে প্রাণীগুলো ছুটোছুটি করতে থাকে।
স্কাউটশিপের ভেতর ইহিতা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সবাই ঠিকমতোন এসেছ?
নীহা মাথা নাড়ল, বলল, এসেছি। সবাই তাহলে নিজেদের জায়গায় বসে যাও। আমরা এখন রওনা দেব।
সবাই নিজেদের জায়গায় বসতেই সিট থেকে যন্ত্রপতি বের হয়ে এসে তাদেরকে নিরাপত্তা বলয়ের মাঝে আটকে নেয়। নীহা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল, নুট নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী দেখার চেষ্টা করছ নীহা?
নীহা বলল, না। কিছু না।
তুমি কী প্রাণীগুলোকে দেখতে চাইছ?
হ্যাঁ। আমার মনে হল, স্পষ্ট মনে হল–কথা শেষ না করে নীহা থেমে যায়।