নিষ্ঠুর চেহারার মানুষটি বিস্ফারিত চোখে মহামান্য থুলের দিকে তাকিয়ে রইল, সে এখনো তার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। মানুষের চেহারায় নিষ্ঠুরতা সরে গিয়ে সেখানে এখন এক ধরনের আতংকের ছাপ পড়তে শুরু করেছে। সে তার শুকনো ঠোঁটকে জিভ দিয়ে ভিজিয়ে মাথা নেড়ে বলল, আমি তোমার একটি কথাও বিশ্বাস করি না।
মহামান্য থুল তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, না করলে নেই। তারপরও তোমাদের জানিয়ে রাখছি। আমার মনে হয় তোমাদের আরো একটা তথ্য জানিয়ে রাখা দরকার। মানুষের উপর যখন বড় বিপদ নেমে আসে তখন তারা একে অন্যের বিভেদ ভুলে যায়, তারা তখন এক সাথে কাজ করে। তার কারণ হচ্ছে মানুষের সভ্যতার জন্মই হয়েছে একজনের জন্যে অন্যের মমতা দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে। রবোমানবেরা তাদের ভেতর থেকে মমতা আর ভালোবাসা তুলে দিয়েছে। তাই রবোমানবেরা যখন বড় বিপদে পড়ে তখন তারা কী করে জান?
কী করে?
তারা স্বার্থপর হয়ে যায়। হিংস্র হয়ে যায়। একে অন্যকে সরিয়ে নেতৃত্ব নিতে চায়। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। তখন কী হয় জান?
নিষ্ঠুর চেহারার মানুষটি কোনো কথা না বলে থুলের দিকে তাকিয়ে রইল। মহামান্য থুল তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তখন রবোমানবেরা একে অন্যকে হত্যা করে! কাজেই আমি কাগজে লিখে দিতে পারি আজ থেকে তিন মাস পরে পৃথিবীতে কোনো রোমানব থাকবে না। যেহেতু নেটওয়ার্ক থেকে কোনো সাহায্য পাবে না তাই একজন আরেক জনকে হত্যা করতে থাকবে!
লালচুলের মেয়েটি বলল, তুমি এটা কী ভাবে জান?
মঙ্গল গ্রহে আমরা ছোট একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছি। সেই এক্সপেরিমেন্টে দেখা গেছে বড় বিপদের মাঝে রবোমানবের মা তার সন্তানকে হত্যা করে ফেলে!
লাল চুলের মেয়েটি নিষ্ঠুর চেহারার দলপতির দিকে তাকাল। দলপতির চেহারায় নিষ্ঠুরতাটুকু সরে গিয়ে এখন সেখানে একধরনের উদ্ভ্রান্ত ভাব চলে এসেছে। লাল চুলের মেয়েটি বলল, আমি কি এখন গুলি করতে পারি।
দলপতি বলল, দাঁড়াও। এক সেকেন্ড। তারপর ঘুরে মহামান্য থুলের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এখনো বিশ্বাস করি না তুমি নেটওয়ার্ক ধ্বংস করেছ। কিন্তু আমি তারপরও জানতে চাই সত্যিই যদি ধ্বংস করে থাক তাহলে সেটি কেমন করে করেছ?
মহামান্য থুল হেসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, তোমার পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব না। তোমার মস্তিষ্ক সেটা বোঝার ক্ষমতা রাখে না।
আমি তবু শুনতে চাই। রবোমানবদের দলপতি ক্ষিপ্ত স্বরে বলল, আমাকে বল।
আমি তোমাকে পুরো ব্যাপারটি বোঝাতে পারব না, বড় জোর তোমাকে একটু ধারণা দিতে পারি। মহামান্য থুল তার আঙুলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, আমি জানি না, তোমরা লক্ষ করেছ কি না প্রিসা নগরীর উত্তরের বনাঞ্চলে একটা আগুন জ্বলছে। শীতের মওসুমে প্রায়ই জ্বলে—এটি এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়। তবে আগুনের কারণে যে ধোয়া হয় সেটা সূর্যের আলোকে আটকে দেয় তাই নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সৌর বিদ্যুতের প্যানেলগুলো প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে না। সেটি এমন কোনো গুরুতর ব্যাপার না, কিন্তু ঠিক একই সময় মাহীরা হদের সুইস গেট খুলে নিচের শুষ্ক অঞ্চল পাবিত করা হয়েছে। খুবই স্বাভাবিক একটা কাজ কিন্তু হদের পানির উচ্চতা কমে গিয়েছে, পানি দিয়ে বিদ্যুৎ প্লান্ট শীতল করা হলে এক সময় সেটি সম্ভব হবে না! তোমরা লক্ষ করেছ কিনা জানি না দুটো বিনোদন উপগ্রহ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, মানুষের বিনোদনের উপায় নেই, নগরীতে বিক্ষোভ হয়েছে তার জন্যে নিরাপত্তা কর্মীরা ব্যস্ত, ঠিক তখন শক্তি কেন্দ্রে তেজস্ক্রিয় আয়োডিন পাওয়া গেছে, নিরাপত্তা কেন্দ্র, শক্তি কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে! মাজুরা ইলেকট্রিক কোম্পানির ফোরম্যানকে অগ্রিম বোনাস দেয়া হয়েছে-এই মানুষটি বোনাস পেলেই শহরে গিয়ে উত্তেজক পানীয় খায়, ভোরে ঠিক করে কাজ করতে পারে না। সেজন্যে সে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি এবং একটা দুর্ঘটনা ঠেকাতে পারেনি। অগ্নিকাণ্ডের জন্যে যে ফায়ারব্রিগেড যাবার কথা তাদেরও সমস্যা হয়েছে সবুজ পৃথিবীর স্কুলের বাচ্চাদের জন্যে! তারা আর্ট মিউজিয়ামে গিয়েছে সকাল দশটায় সেজন্যে রাস্তাটা সাময়িকভাবে বন্ধ! এরকম অসংখ্য ছছাট ছোট ঘটনা আলাদা আলাদা ভাবে পুরোপুরি গুরুত্বহীন। কিন্তু যখন একটার সাথে আরেকটা জুড়ে দেখ দেখবে সেটি ভয়াবহ বিপজ্জনক! নেটওয়ার্কের কেন্দ্রটি ধ্বংস হয়ে যাবে। গিয়েছে!
রবোমানবের দলপতি হিংস্র গলায় বলল, তার মানে তুমি দাবি করছ কী করলে কী হবে তার সবগুলো তুমি আগে থেকে জান?
হ্যাঁ জানি। আমাকে কেউ দাবা খেলায় কখনো হারাতে পারে না—কী হলে কী হতে পারে তার সম্ভাব্য সবকিছু আমি বলতে পারি। এখানেও আমি বলতে পারি, তাই কিছু ছোটখাট ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এর সবগুলোর সম্মিলিত ফল হচ্ছে নেটওয়ার্ক ধ্বংস হওয়া। মহামান্য থুল বললেন, ক্যাওস থিওরি বলে একটা থিওরি আছে। সেখানে বলা হয় এখানে হয়তো একটা প্রজাপতি তার ডানা ঝাঁপটেছে–তার ফলস্বরূপ অন্য গোলার্ধে একটা ঘূর্ণিঝড় হয়ে যাবে! এখানেও তাই, পার্থক্য হল আমি নিজের হাতে একটি একটি করে সেটা সাজিয়েছি।
রবোমানবের দলপতি বলল, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না!
ঠিক আছে। তোমার ইচ্ছা। মহামান্য থুল কাঁধ ঝাঁকিয়ে চুপ করলেন।
লাল চুলের মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, আমি কী এখন এই বুড়োটিকে গুলি করব!