নীহা চিৎকার করে বলল, মহামান্য গুল? আপনি?
নীহার কথাটি মহামান্য থুল সেই মুহূর্তে শুনতে পেলেন না। মঙ্গল গ্রহ থেকে পৃথিবীতে তার কথাটি পৌঁছাতে কমপক্ষে পাঁচ মিনিট সময় নেবে, মহামান্য থুলের উত্তরটি ফিরে আসতে আরো পাঁচ মিনিট। নীহা এবং অন্যেরা শুনতে পেলো মহামান্য থুল ঠিক সেই কথাটিই বললেন, মুখোমুখি কথা বলার যে সুবিধেটুকু আছে সেটি এখন আমাদের মাঝে নেই, তোমাদের কথা আমার কাছে এবং আমার কথা তোমাদের কাছে পৌঁছানোর মাঝে বেশ অনেকখানি সময় নেবে। তোমরা কেমন আছ আমি জানি না। আমার জানা প্রয়োজন। আমি এখন চুপ করছি, তোমরা বল। কেমন আছ বল।
টুরান বলল, এর মাঝে অনেক কিছু ঘটে গেছে। কোনো মানুষের জীবনে এতো অল্প সময়ে এতো কিছু ঘটতে পারে সেটা বিশ্বাসই হতে চায় না। মহামান্য থুল আপনি শুনে খুশি হবেন যে আমরা ভয়ংকর ভয়ংকর বিপদের মাঝে থেকেও রক্ষা পেয়েছি। কীভাবে সেটা ঘটেছে সেটা আপনাকে বলবে ইহিতা। আমরা ইহিতাকে আমাদের দলপতি তৈরি করেছি। ইহিতা একজন অসাধারণ-দলপতি, সে কীভাবে আমাদের রক্ষা করে এনেছে সেটি শুনলে আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন! টুরান ইহিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ইহিতা! তুমি বল।
ইহিতা একটু বিব্রত হয়ে বলল, আমি এমন কিছুই করি নি! তারপর সে একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে মহাকাশযানে কী ঘটেছে এবং কীভাবে তারা শেষ পর্যন্ত এই নিরাপদ আবাসস্থলে আশ্রয় নিয়েছে সেটি বলল। তাদের ভেতরে যে দুজন রবোমানব আছে এবং সেই দুজন শেষ পর্যন্ত কীভাবে নিজেরাই নিজেদের হত্যা করেছে সেটি বলার সময় ইহিতার মুখে গভীর একটা বেদনায় ছাপ পড়ে।
ইহিতার কথা শেষ হবার পর প্রায় দশ মিনিট সময় পরে তারা মহামান্য থুলের কথা শুনতে পেল, মহামান্য থুল বললেন, পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে একটা নির্জন গ্রহের ছোট একটা আবাসস্থলে তোমরা কোনো ভাবে নিজেদের রক্ষা করে বেঁচে আছ। কিন্তু আমি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। সত্যি কথা বলতে কী শুধু আমি নই, পৃথিবীর মানুষ তোমাদের কাছে ঋণী থাকবে। তোমরা সবাই জান রবোমানবেরা কিছুক্ষণের মাঝেই পৃথিবীর নেটওয়ার্কটি দখল করে নেবে। দখল করার পর নিশ্চিতভাবেই তারা আমাকে এবং বিজ্ঞান আকাদেমীর সবাইকে হত্যা করতে আসবে। আমি সেটা নিয়ে খুব বেশি দুর্ভাবনা করছি না। তোমরা জান আমি দীর্ঘ একটি আনন্দময় জীবন কাটিয়েছি, আমি এখন খুব আনন্দের সাথে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারি। কিন্তু আমাদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করতে আমরা কি সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি? রবোমানব যখন নেটওয়ার্ক দখল করে এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি প্রাণী, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, প্রতিটি কমিউনিটি, প্রতিটি অস্ত্রাগার প্রতিটি যোগাযোগ ব্যবস্থা এক কথায় পুরো পৃথিবীর সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে তখন পৃথিবীর মানুষ রবোমানবের হাতে ধ্বংস হয়ে যাবে?
মহামান্য থুল একটু থামলেন, অন্যমনস্কভাবে নিজের হাতের দিকে তাকালেন তারপর আবার মাথা তুলে সামনের দিকে তাকালেন, তাকিয়ে বললেন, এর সঠিক উত্তর কেউ জানতো না। এখন আমি জানি। ভবিষ্যতে যে ভয়ংকর বিপদটি আসবে সেই বিপদের মাঝে মানুষ ভেঙে পড়বে না। তোমরা যেমন ভেঙে পড়নি। তারা নিজেদের মাঝে নেতৃত্ব তৈরি করে নেবে। সেই নেতৃত্বকে মেনে নিয়ে তারা একে অন্যকে সাহায্য করবে। ঠিক যেরকম তোমরা করেছ। আর ঠিক তখন যদি আমরা রবোমানবকেও একই ধরনের বিপদের মাঝে ফেলতে পারি তখন তারা হবে ভয়ংকর রকম স্বার্থপর, তারা হবে হিংস্র, তারা হবে নিষ্ঠুর, তারা নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে একে অন্যকে হত্যা করবে। ঠিক এখানে যেরকম করেছে।
মহামান্য থুল একটু হাসির মতো ভঙ্গি করলেন, তোমাদের প্রতি পৃথিবীর মানুষের কৃতজ্ঞতা! তোমাদের কাছ থেকে আমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি পেয়েছি। আমাদের কী করতে হবে সেটা নিয়ে আমি একটু ভাবনার মাঝে ছিলাম, আমার ভাবনা দূর হয়েছে।
মহামান্য থুলের কথা শেষ হবার আগেই সবাই প্রায় এক সাথে চিৎকার করে উঠল, কিন্তু আপনার কী হবে? আপনার কী হবে?
তারা সেই প্রশ্নের উত্তর পেল না, প্রশ্নটি মঙ্গলগ্রহ থেকে পৃথিবীতে গিয়ে সেখান থেকে আর ফিরে এলো না, তার কারণ ততক্ষণে সেখানে একটি মহাপ্রলয় শুরু হয়ে গেছে।
১৯. লাল চুলের মেয়েটি
লাল চুলের মেয়েটি টেবিলে কাচের জারে তরলের মাঝে ড়ুবিয়ে রাখা থলথলে মস্তিষ্কটির দিকে একধরনের বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে রইল তারপর খুট করে সুইচটাতে চাপ দিয়ে মাইক্রোফোন অন করে বলল, এই, তুমি কী জেগে আছ?
স্পিকারে একটা ক্ষীণ শব্দ শোনা গেল, জেগে আছি।
আমার হয়েছে মুশকিল, কাচের জারে তোমাকে-তার মানে এই থলথলে মস্তিষ্কটা দেখতেই কেমন জানি গা ঘিনঘিন করে, আবার একটু কথা না বললে ভালোও লাগে না।
তোমার কাছে আমার অনুরোধ তুমি আমাকে ধ্বংস করে দাও! আমার এই অস্তিত্ব যে কী ভয়ংকর তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।
লাল চুলের মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল, কে বলেছে কল্পনা করতে পারি না। অবশ্যই পারি! কল্পনা করতে পারি বলেই তো তোমাকে বাঁচিয়ে রাখছি। তুমি হচ্ছ আমার সবচেয়ে বড় বিনোদন।
স্পিকার থেকে কাতর একটি কণ্ঠস্বর ভেসে ওঠে, দোহাই তোমার! দোহাই আমাকে আর কষ্ট দিও না। আমাকে শেষ করে দাও।