মহামান্য থুলের মুখ থেকে কাঠিন্যটুকু সরে গিয়ে সেখানে তার পরিচিত হাসিটুকু ফুটে উঠল। তিনি সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বললেন, চমৎকার! এখন আমরা সবাই নিশ্চিতভাবে জানি এখানে আমরা সবাই মানুষ। আমরা এখন মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে পারব।
মহামান্য থুল গ্রানাইটের মসৃণ টেবিলটার উপর অন্যমনস্কভাবে টোকা দিতে দিতে বললেন, তোমরা সবাই জান আমি কেন তোমাদের ডেকে এনেছি। এখানে আমরা যে কথা বলব পৃথিবীর কেউ সে কথাগুলো জানবে না। এগুলো রেকর্ড করা হবে না তাই ভবিষ্যতেও কেউ কখনো জানতে পারবে না। আমি এই সিদ্ধান্তগুলো কেন নিয়েছি সেটা তোমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছ?
কেউ কোনো কথা বলল না, কয়েকজন শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। মহামান্য থুল বললেন, তোমরা সবাই জান রবোমানব প্রজেক্টটি আমাদের অনুমতি ছাড়া শুরু করা হয়েছিল। মানুষের মনুষত্ববোধ থাকবে না কিন্তু মানুষের বুদ্ধিমত্তা থাকবে এরকম রবোট তৈরি করার অনুমতি পৃথিবীর নির্বোধতম মানুষটিও দেবে না। আর সেগুলোকে মানুষের রূপ দিয়ে এন্ড্রয়েড তৈরি করতে দেয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু সেটাই ঘটেছে। যখন আমাদের শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেটা ধরতে পেরেছে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিছু শহরের কিছু কাউন্সিলার তার জন্যে দায়ী। তারা তাদের শহরে গোপন এন্ড্রয়েড শিল্প গড়ে উঠতে দিয়েছে। কারা দায়ী, কীভাবে সেটা গড়ে উঠতে পেরেছে সেটা নিয়ে আলোচনা করা এখন একটি একাডেমিক ব্যাপার। আমি সেটা নিয়ে আলোচনা করার জন্যে তোমাদের ডাকি নি। আমি ডেকেছি অন্য কারণে। আমি সেটি বলার আগে আমাদের তথ্য প্রক্রিয়াকরণ বিজ্ঞানী জুহুকে বর্তমান পরিস্থিতিটি ব্যাখ্যা করতে বলব।
তথ্য প্রক্রিয়াকরণ বিজ্ঞানী জুহু মাথা নিচু করে বলল, আমি এই আকাদেমীর কাছে ক্ষমা চাইছি, আমি আমার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারি নি।
মহামান্য থুল বললেন, আমি তোমাকে আত্মবিশ্লেষণ করতে বলি নি। তোমাকে আমি শুধুমাত্র বর্তমান পরিস্থিতির উপর একটা রিপোর্ট দিতে বলেছি।
তথ্য প্রক্রিয়াকরণ বিজ্ঞানী জুহু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যখন আমরা ভেবেছিলাম আমরা অবস্থাটি আয়ত্তের মাঝে আনতে যাচ্ছি ঠিক তখন আমরা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যাচ্ছি। রবোমানবেরা এখন সংঘবদ্ধ শক্তি, তারা নিজেরা নিজেদের তৈরি করছে। কিন্তু আপনারা সবাই জানেন একসময় কিছু মানুষ ওদের তৈরি করেছিল। জৈবিক মানুষ ব্যবহার করে তাদের তৈরি করা হয় মস্তিষ্ক থেকে মানবিক অনুভূতিগুলো সরিয়ে নিয়ে সেখানে নিউরনগুলোকে নতুন করে পুনর্বিন্যাস করা হয়–সেজন্যে আমাদের স্বীকার করতেই হবে তাদের বুদ্ধিমত্তা মানুষ থেকে বেশি। যেহেতু তাদের কোনো মানবিক অনুভূতি নেই তাই তারা হচ্ছে ভয়ংকর একরোখা-তারা যে কোনো কিছু করে ফেলতে পারে। সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধ করতেও তাদের এতোটুকু দ্বিধা হয় না।
জুহু একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, পৃথিবী থেকে অপরাধ ধীরে ধীরে ওঠে যাচ্ছে। একসময় মানুষ যে কারণে অপরাধ করত এখন সেই কারণগুলোর বেশিরভাগই নেই, তাই অপরাধ করার প্রয়োজনও হয় না। তারপরেও ছোটখাট কিংবা বড়সড়ো অপরাধ যখন কেউ করে আমাদের নিরাপত্তাবাহিনী তাদের ধরতে পারে। আমাদের নেটওয়ার্ক পূর্ণাঙ্গ নেটওয়ার্ক, সবার সুনির্দিষ্ট তথ্য সেখানে আছে, কেউ এর বাইরে কখনো যেতে পারে না।
জুহু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, হঠাৎ করে তাকে কেমন জানি হতাশাগ্রস্থ এবং ক্লান্ত মনে হয়। অনেকটা অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, এই পূর্ণাঙ্গ নেটওয়ার্কটিই হয়েছে আমাদের সর্বনাশ। আমরা এই নেটওয়ার্কের ওপর খুব বেশি নির্ভর করি। রোমানবেরা এই নেটওয়ার্কের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, নেটওয়ার্কের তথ্য পরিবর্তন করে তাদের সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তারা সর্বশেষ কী করার চেষ্টা করছে শুনলে আপনারা হতবাক হয়ে যাবেন।
পদার্থবিদ ক্রন একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, কী করার চেষ্টা করছে?
তারা ডাটাবেসের তথ্য এমনভাবে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে যে লোবোগ্রাফি করে আমরা যখন একজন রবোমানবকে আলাদা করি, নেটওয়ার্ক তখন যেন তার আসল তথ্য লুকিয়ে তার সম্পর্কে বানানো তথ্য দেয়। তারা যদি সেটা করতে পারে আমরা তখন কোনোভাবে তাদের খুঁজে পাব না। তারা আমাদের মাঝে লুকিয়ে থেকে একদিন আমাদের পরাজিত করে পুরো পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। এই পৃথিবীতে মানুষ থাকবে না, থাকবে শুধু রবোমানব।
জীববিজ্ঞানী ত্রানা বলল, সমস্যাটা কী তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। প্রাচীনকালে রবোট তৈরি হতো যন্ত্রপাতি দিয়ে! লোহালক্কর, ফটোটিউব, ভালব, ইলেকট্রনিক, ফটোট্রনিক সার্কিট দিয়ে। তাদের খুঁজে বের করতে হত নাএমনিতেই তারা মানুষ থেকে আলাদা হয়ে থাকত! এই রবোমানবেরা সেরকম নয়। তারা পুরোপুরি মানুষ, শুধুমাত্র তাদের মস্তিষ্কটা নতুনভাবে ম্যাপিং করেছে। নিউরনগুলোকে ওভারড্রাইভ করার জন্যে মস্তিষ্কের একেবারে ভেতরে, যেটাকে থ্যালামাস বলে সেখানে একটা অত্যন্ত ছোট, চোখে দেখা যায় না এতো ছোট মাইক্রোস্কোপিক ইমপ্লান্ট বসানো হয়। সেটা কিছুক্ষণ পরপর নিউরনগুলোকে বাড়তি স্টিমুলেশান দেয়। শুধু যে স্টিমুলেশান দেয় তা নয় সেটা দিয়ে ম্যাপিং পরিবর্তন করে ফেলতে পারে, একটি রবোমানবকে ভিন্ন রবোমানবে পাল্টে দিতে পারে, নতুন তথ্য ঢুকিয়ে দিতে পারে। এদের প্রোগ্রাম করা যায় কিন্তু এরা পুরোপুরি জৈব মানুষ। সেজন্যে এদের কোনোভাবে ধরা যায় না।