টর থতমত খেয়ে বলল, আমি দুঃখিত।
ইহিতা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার কেন জানি মনে হয় তুমি আসলে সেরকম দুঃখিত নও। কিন্তু শুনে রাখ–
কী?
মানুষের আবাসস্থলে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমি তোমাদের দলপতি। তোমাদের আমার কথা শুনতে হবে। এটা একটা আদেশ। মনে থাকবে?
মনে থাকবে।
যদি মনে থাকে তাহলে আমাকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। ঠিক আছে?
টর পাথরের মতো মুখ করে বলল, ঠিক আছে।
সাতজনের ছোট দলটা তখন মঙ্গলগ্রহের রুক্ষ পাথরের উপর দিয়ে হাঁটতে থাকে। তাদের হাঁটার গতি দ্রুত। যেভাবে হোক তারা মানুষের আবাসস্থলে পৌঁছাতে চায়।
সাতজনের ছোট দলটি যখন মানুষের আবাসস্থলের কাছাকাছি পৌঁছেছে তখন সূর্যটি বেশ উপরে ওঠে গেছে। সূর্যের ম্লান আলোতে মঙ্গলগ্রহের বিস্তীর্ণ প্রান্তরকে কেমন যেন নিঃসঙ্গ দেখায়। টর বলল, আমার মনে হয় আমরা শেষ পর্যন্ত আবাসস্থলে পৌঁছে গেছি।
নীহা বলল, হ্যাঁ। আরো কয়েকদিনের জন্যে বেঁচে থাকার সুযোগ হল।
টর বলল, ব্যাপারটা ভালো হল কি না বুঝতে পারছি না!
নীহা বলল, জীবন কখনো খারাপ হতে পারে না। জীবন সবসময়ই ভালো।
কে বলেছে? সুহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সবকিছু অন্যরকমও হতে পারে।
হলেও আর কতোটুকু হবে?
অনেকখানি হতে পারে।
নীহা ভুরু কুঁচকে বলল, কীভাবে?
সুহা বলল, কাছে এসো দেখাচ্ছি।
নীহা দুই পা এগিয়ে সুহার কাছে যেতেই সে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা নীহার মাথায় ধরল। মুহর্তে সুহার চেহারাটি একটি হিংস্র মানবীতে পাল্টে গেল। সে হিসহিস করে বলল, সবাই তোমাদের হাতের অস্ত্র নিচে ফেলে দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াও। এক সেকেন্ড দেরি করলে এই নির্বোধ মেয়েটার খুলি ফুটো হয়ে যাবে।
সবাই হতবাক হয়ে সুহার দিকে তাকিয়ে থাকে। সুহা প্রায় যান্ত্রিক গলায় বলল, এখনো যদি না বুঝে থাক তাহলে পরিষ্কার করে বলে দিই। আমি দুজন রবোমানবের একজন।
টুরান কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, আরেকজন কে?
ক্লদ বলল, আমি।
সবাই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল, তুমি!
হ্যাঁ আমি। বলে ক্লদ এগিয়ে নীহার হাত থেকে হ্যাচকা টান মেরে তার অস্ত্রটা নিয়ে নেয়।
সুহা সবার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল, আমি তোমাদের সাথে খোশগল্প করার জন্যে আসি নি। হাতের অস্ত্র নিচে ফেল।
টর ইহিতাকে জিজ্ঞেস করল, ইহিতা, কী করব? তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে এই ডাইনিবুড়িকে শেষ করে দিই।
তাহলে অন্যদের কথা জানি না কিন্তু নিশ্চিতভাবে নীহাকে হারাব।
সুহা চিষ্কার করে বলল, বাজে কথা বল না। অস্ত্র ফেল, তা না হলে এই মুহূর্তে এর খুলি উড়িয়ে দেব।
ইহিতা এক পা এগিয়ে এসে বলল, আমার মনে হয় না তুমি এই মুহূর্তে সেটা করবে। তুমি রবোমানব হতে পার কিন্তু রবোট নওনীহার মাথায় গুলি করা মাত্রই আমাদের চারজনের অস্ত্র তোমাকে ঝাঁঝরা করে দেবে! কাজেই তুমি এতো সহজে গুলি করবে না।
তুমি রবোমানবকে চেনো না। রবোমানবের ভেতরে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা নেই
শব্দটা দুর্বলতা নয়। শব্দটা হচ্ছে মানবিক মায়া মমতা-
সুহা হিস হিস করে বলল, অর্থহীন কথা বলে সময় নষ্ট কর না। তোমাদের মানবিক মায়ামমতা দুর্বলতা কি না সেটা এই মুহূর্তে প্রমাণিত হবে! তোমাদের নিজেদের রক্ষা করার একটি মাত্র উপায়-সেটি হচ্ছে আমাকে গুলি করা। করো গুলি। চিৎকার করে বলল, করো।
নীহা হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
সুহা হিংস্র ভঙ্গিতে বলল, করতে পারবে না। কাজেই সময় নষ্ট করো না। হাতের অস্ত্র ফেলে দাও।
ইহিতা অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, সে ঠিকই বলেছে। আমাদের আর কিছু করার নেই–হাতের অস্ত্র ফেলে দিতে হবে।
টর বলল, কিন্তু এই ডাইনি বুড়ি তাহলে সাথে সাথে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে।
সম্ভবত। কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই, অন্তত নীহা জানবে আমরা আমাদের নিজেদের বাঁচানোর জন্যে তাকে মারা যেতে দিই নি।
টর কাঁপা গলায় বলল, তুমি আমাদের দলপতি, তুমি যেটাই বলবে আমি সেটাই শুনব। আমরা কি শেষ চেষ্টা করব না?
ইহিতা বলল, ক্লদের দিকে তাকাও। দেখো সে কীভাবে অস্ত্রটা তোমার দিকে তাক করে ধরেছে। সম্ভবত সে তোমাকে গুলি করবে, কিন্তু তুমি কি পারবে এই চার বছরের শিশুটাকে গুলি করে মারতে?
টর মাথা নাড়ল, বলল, না।
আমি জানি তুমি আমি কেউ পারব না। আমরা মানুষ সেই জন্যে এখানে এই মুহূর্তে হয়তো সবাই মারা যাব। কিন্তু জেনে রাখো যে কারণে আমরা সবাই এখানে মারা যাব ঠিক সেই কারণে পৃথিবীর অসংখ্য জায়গায় অসংখ্য মানুষ একে অপরকে বাঁচিয়ে রাখবে।
সুহা চিৎকার করে বলল, অস্ত্র ফেল।
টর ইহিতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ইহিতা। তুমি আমাদের দলপতি। তুমি বল, অস্ত্র ফেলব?
আমি খুবই দুঃখিত টর, কিন্তু আমাদের অস্ত্র ফেলতে হবে।
টর হাতের অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলল। ইহিতা আর টুরান তাদের অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলল। নুট তার হাতের অস্ত্র তুলে বলল। আমি আমার হাতের অস্ত্রটি ছুঁড়ে ফেলার আগে একটি কথা বলতে পারি?
কী কথা?
নুট একটু এগিয়ে এসে বলল, মনে আছে আমি বলেছিলাম আমি জানি আমাদের ভেতরে কোন দুজন রবোমানব? তোমরা কী বিশ্বাস কর আমি সেটা জানতাম?
সুহা মাথা নাড়ল, বলল, অসম্ভব। আমরা পুরো সময় নির্বোধ মানুষের মতো অভিনয় করে গেছি।
নুট এক হাতে তার অস্ত্রটি ধরে রেখেছিল, অন্য হাতটি উপরে তুলে দেখিয়ে বলল, এটা কী দেখেছ?