নীহা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হয়েছে?
প্রাণীগুলো আসছে। রেডিয়েশান মিটারে আমরা সিগন্যাল পাচ্ছি।
সর্বনাশ! এখন কী হবে?
ইহিতা বলল, যা হবার সেটাই হবে। ভয় পাবার কিছু নেই। অস্ত্রটা তৈরি রাখ।
নীহা অস্ত্রটা তাক করে গুড়ি মেরে বসে বলল, আমরা তো নড়ছি না, প্রাণীগুলো আমাদের দেখছে কেমন করে?
জানি না। মনে হয় বাইরের তাপমাত্রা কমে যাবার কারণে আমাদের স্পেসস্যুট থেকে অনেক বেশি তাপ বিকিরণ করছে।
নীহা কথা না বলে তার চোখের গগলসটি অতি বেগুনি রশ্মিতে সংবেদনশীল করে নিল, সাথে সাথে চারপাশের জগৎটা অন্য রকম দেখাতে থাকে, তার মাঝে সে দূরে প্রাণীগুলোকে দেখতে পেল। সেগুলো গুড়ি মেরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে, খুব ধীরে ধীরে চারদিকে থেকে তাদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে।
ইহিতা ফিসফিস করে বলল, আমি না বলা পর্যন্ত কেউ গুলি শুরু করবে না।
ঠিক আছে।
সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল, দেখতে পেলো প্রাণীগুলো তাদের দিকে দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে। রেডিয়েশন মিটারের কাটাটি নড়তে থাকে, প্রাণীগুলো থেকে চারপাশে তীব্র তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রাণীগুলো আরেকটু কাছে এগিয়ে এল, এখন তাদের চেহারাগুলো দেখা যেতে শুরু করেছে। তারা অবাক হয়ে লক্ষ করল প্রাণীগুলো একরকম নয়, তাদের মাঝে গঠনগত একটা মিল আছে, সবগুলোরই সামনে বীভৎস ধারালো দাঁত, বড় মুখ। মুখটি কখনো শরীরের উপর, কখনো নিচে। অনেকগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। কখনো তাদের অতিকায় মাকড়শার মতো মনে হয়, কখনো ক্লেদাক্ত কীটের মতো মনে হয়।
প্রাণীগুলো আরেকটু এগিয়ে এল, তাদের হিংস্র গর্জন খুব ক্ষীণভাবে তারা শুনতে পায়। মাটিতে মৃদু কম্পন অনুভব করতে পারে।
যদিও কথা ছিল ইহিতা অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত কেউ গুলি করবে না, কিন্তু হঠাৎ করে টর প্রচণ্ড আক্রোশে গুলি করতে শুরু করল। সাথে সাথে যেন নরক নেমে আসে, প্রাণীগুলো ছুটে তাদের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সেগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু তারপরেও সেগুলো থেমে যায় না–আরো ভয়ংকর আক্রোশে সেগুলো ছুটে আসতে থাকে। প্রাণীগুলোর ছিন্নভিন্ন দেহগুলোও গড়িয়ে গড়িয়ে পাথরে ঘষতে ঘষতে কাঁপতে কাঁপতে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।
ইহিতা বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে একটা প্রাণীকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়ার পরও তার প্রতিটি অংশ যদি আলাদাভাবে জীবিত থেকে যায় প্রতিটি অংশই যদি নিজের মতো করে তাদের আক্রমণ করতে থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে তারা কেমন করে টিকে থাকবে?
ইহিতা তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে কয়েকবার গুলি করে প্রাণীগুলোকে খানিকটা দূরে সরিয়ে দিল। তারপর দ্রুত তার পকেট থেকে রিমোট কন্ট্রোলটা বের করে। পথের মাঝখানে সে একটা সনিক চার্জার বসিয়ে এসেছে, সেটা ব্যবহার করা যায় কীনা পরীক্ষা করে দেখতে চায়।
রিমোট কন্ট্রোলের প্যানেলটি চোখের সামনে ধরে সে দ্রুত তার রেটিনা স্ক্যানিং করে নিয়ে বোতামগুলো স্পর্শ করে। প্রায় সাথে সাথেই সে একটা কম্পন এবং একটু পর বিস্ফোরণের চাপা শব্দ শুনতে পেল। ইহিতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ক্ষ্যাপা প্রাণীগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল এবং হঠাৎ করে তার মনে হল প্রাণীগুলোর মাঝে এক ধরনের নতুন চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে।
ইহিতা চিৎকার করে বলল, থামাও। গুলি থামাও! সবাই গুলি থামাও।
সবাই গুলি থামাল এবং দেখতে পেল হঠাৎ প্রাণীগুলো পিছনে ছুটে যেতে শুরু করেছে। ছুটে যাবার সময় প্রাণীগুলো তাদের শরীরের ছিন্নভিন্ন অংশগুলো মুখে করে নিয়ে যেতে থাকে। শরীরের নানা অংশে সেগুলো ছুঁড়ে দিতে থাকে এবং সেগুলো শরীরে লেগে কিলবিল করে নড়তে থাকে।
ইহিতা রদ্ধশ্বাসে এই বিচিত্র দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে বলল, এখন গুলি করো না–প্রাণীগুলোকে চলে যেতে দাও।
নীহা কাঁপা গলায় বলল, কোথায় যাচ্ছে? আমি যেখানে সনিক চার্জার লাগিয়ে এসেছি সেখানে। কেন?
প্রথমবার যখন প্রাণীগুলো আমাদের দিকে ছুটে এসেছিল তখন হঠাৎ করে ছুটে চলে গিয়েছিল, মনে আছে?
মনে আছে।
আমি পরীক্ষা করে দেখেছিলাম–দূরে একটা বিস্ফোরণ হয়েছিল। বিস্ফোরণের পর খুব ছোট কম্পনের শব্দ তরঙ্গ ভেসে এসেছিল, ভূমিকম্পের বেলায় যেরকম হয়। তাই ভাবলাম-
কী ভাবলে?
প্রাণীগুলো ছোট কম্পনের শব্দ তরঙ্গ শুনতে পেলে সেদিকে নিশ্চয়ই ছুটে যায়। তাই পথে একটা সনিক চার্জার লাগিয়ে এসেছিলাম। এখান থেকে রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে সেটা বিস্ফোরণ করিয়েছি। আসলেই প্রাণীগুলো সেদিকে ছুটে গেছে।
কেন? কেন ছুটে যায়?
এখনো জানি না, কিন্তু সেটা নিয়ে পরে চিন্তা করা যাবে। আমাদের এক্ষুণি রওনা দিতে হবে। আমাদের কাছে আর সনিক চার্জার নেই, প্রাণীগুলো আবার আক্রমণ করলে আর ফেরাতে পারব না। এক্ষুণি রওনা দিতে হবে।
টুরান বলল, তাছাড়াও এই তেজস্ক্রিয় প্রাণীগুলো থেকে অনেক তেজস্ক্রিয় পদার্থ বের হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয়।
নীহা বলল, হ্যাঁ চল রওনা দিই। ট্রান্সপোর্টারে করে আমি ক্লদকে নিতে পারি।
ক্লদ মাথা নাড়ল, বলল, না। আমি ট্রান্সপোর্টারে যাব না। আমি হেঁটে যাব।
নীহা মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।
ইহিতা টরের দিকে তাকিয়ে বলল, আর টর, শোনো।
বল।
আমি কিন্তু বলেছিলাম আমি নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কেউ গুলি করবে না। তুমি আমার নির্দেশ শোনো নি। তুমি আগেই গুলি শুরু করেছ।