কীভাবে?
অস্ত্র দিয়ে। ইহিতা ডানে বামে তাকাল, বলল, পিছনে বড় পাথরগুলো আছে, এখানে দাঁড়াই তাহলে শুধু সামনের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। তাড়াতাড়ি প্রস্তুতি নাও। শোনো খুব কাছে না আসা পর্যন্ত গুলি কর না। গুলি যেন লক্ষ্যভ্রষ্ট
হয়।
সবাই ছুটে বিশাল পাথরটাকে পিছনে রেখে দাঁড়াল। ইহিতা হেলমেটের সুইচ টিপে সেটাকে ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর জন্যে সংবেদনশীল করার চেষ্টা করে। অবলাল আলোতে কিছু দেখতে পেল না কিন্তু আলট্রাভায়োলেট তরঙ্গে যেতেই সে প্রাণীগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পায়। অনেকগুলো প্রাণী গুড়ি মেরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। প্রাণীর শরীরের যে জায়গা থেকে অতিবেগুনি রশ্মি বের হচ্ছে শুধু সেই অংশটুকু দেখতে পাচ্ছে তাই প্রকৃত আকারটা বোঝা যাচ্ছে না। অনুমান করা যায় প্রাণীটি আকারে খুব উঁচু নয়–হাত-পা থাকতে পারে, দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে।
ইহিতা ফিসফিস করে বলল, তোমাদের হেলমেট অতিবেগুনি রশ্মিতে সংবেদনশীল করে নাও।
নীহা জানতে চাইল, তাহলে কী হবে?
প্রাণীগুলো দেখতে পাবে।
নীহার সাথে সাথে অন্য সবাই তাদের হেলমেটের গগলস অতি বেগুনি রশ্মিতে সংবেদনশীল করে নিল, সাথে সাথে দুলতে দুলতে এগিয়ে আসা প্রাণীগুলো দেখতে পায়। টর চাপা স্বরে একটা কুৎসিৎ গালি দিয়ে বলল, আরেকটু কাছে আয় হতভাগারা–অনেকদিন কারো উপর গুলি চালাই নি।
ইহিতা ফিসফিস করে বলল, সাবধান, প্রয়োজন না হলে গুলি করো না।
কেমন করে বুঝব প্রয়োজন নেই!
যদি দেখ প্রাণীগুলো থেমে গেছে। যদি দেখ আমাদের দিকে এগিয়ে না এসে ইতস্তত অন্যদিকে যাচ্ছে।
কেন থেমে যাবে? কেন ইতস্তত অন্যদিকে যাবে?
ইহিতা ফিসফিস করে বলল জানি না। শুধু দেখ যায় কি না।
সবাই অস্ত্র তাক করে নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে ঠিক তখন যেন ইহিতার ধারণাকে সত্যি প্রমাণ করার জন্যেই প্রাণীগুলোর গতি কমে আসে, প্রাণীগুলোর অনেকগুলো থেমে যায়, অনেকগুলো ইতস্তত এদিক-সেদিক হাঁটতে থাকে।
টুরান ফিসফিস করে বলল, কী হয়েছে? ইহিতা বলল, সবাই চুপ। কেউ একটা কথা বলবে না। একটা শব্দ করবে। কোনো কিছু না নড়লে প্রাণীগুলো দেখতে পায় না। কেউ নড়বে না। একেবারে কাছে এলেও নড়বে না।
সবাই নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকে। প্রাণীগুলো ইতস্তত এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়ে। একটা প্রাণী তাদের কাছাকাছি এসে ডানদিকে সরে যায় সেখান থেকে হঠাৎ করে ঘুরে সোজাসুজি তাদের দিকে এগিয়ে আসে। সুহা ফিসফিস করে বলল, সর্বনাশ!
অন্য কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই দেখল কিছু একটা দুলতে দুলতে তাদের দিকে আসছে। কাছাকাছি আসার পর প্রথম প্রাণীটার অবয়ব স্পষ্ট দেখা যায়। রেডিয়েশন মিটারটি নিঃশব্দ করে রাখা আছে বলে সেটি শব্দ করছে না কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রচণ্ড রেডিয়েশনে তার কাটাটি থরথর করে কাঁপছে।
প্রাণীটি আরো কাছে এগিয়ে আসে, এটি পৃথিবীর কোনো প্রাণীর মতো নয়। মনে হয় মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে একটি অতিকায় কুৎসিত ক্লেদাক্ত কীট তৈরি করা হয়েছে। ধারালো দাঁতের পিছনে লকলকে জিব। চোখ আছে কী নেই বোঝা যায় না। প্রাণীটি খুব কাছে এসে তাদেরকে পরীক্ষা করে দেখল তারপর একটু বাম দিকে সরে দুলতে দুলতে নড়তে নড়তে সরে গেল। হঠাৎ করে তারা মাটিতে একটা কম্পন অনুভব করে সাথে সাথে সবগুলো প্রাণী একসাথে ঘুরে গেল তারপর ছুটতে ছুটতে দূরে অদৃশ্য হয়ে গেল। ইহিতা ফিসফিস করে বলল, এখনো কেউ কোনো শব্দ করো না। কেউ একটুও নড়ো না। প্রাণীগুলো আগে একেবারে সরে যাক।
যখন প্রাণীগুলো একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল তখন নীহা একটা দীর্ঘশ্বাসকে বুক থেকে বের করে দিয়ে বলল, খুব বাঁচা বেঁচে গেছি।
টর বলল, একটা গুলি পর্যন্ত করতে পারলাম না।
তুমি গুলি করতে চাইছিলে?
হ্যাঁ। অনেকদিন কোনো অস্ত্র ব্যবহার করি নি, হাত নিশপিশ করছিল।
সবাই এক ধরনের সন্দেহের চোখে টরের দিকে তাকিয়ে থাকে। টুরান একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি একটা কথা বলতে পারি?
সবাই এবার ঘুরে টুরানের দিকে তাকাল, সুহা বলল, বল।
টুরান বলল, তোমাদের মনে আছে আমরা যখন মহাকাশযানে করে আমাদের যাত্রা ঠিক শুরু করতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখন ইহিতা আমাদের সবার সাথে একবার কথা বলতে চাইছিল?
সবাই মাথা নাড়ল। টুরান বলল, আমি এক ধরনের গোয়ার্তুমি করে ইহিতাকে কথা বলতে দিই নি। তার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। অপমানসূচক কথা বলেছিলাম।
ইহিতা নিচু গলায় বলল, তুমি এমন কিছু অপমানসূচক কথা বল নি।
বলেছিলাম। আমার খুব কাছাকাছি থাকা একটি মেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল সেই থেকে আমি পুরোপুরি নারী জাতির বিদ্বেষী হয়ে গিয়েছিলাম কোনো মেয়েকে সহ্যই করতে পারতাম না। কোনো মেয়ের কথাও শুনতে চাইতাম না। বিষয়টা খুবই বড় নির্বুদ্ধিতা হয়েছিল।
কেউ কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে টুরানের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল সে কী বলতে চাইছে।
ইহিতা তখন যে কথাগুলো বলতে চাইছিল, আমি এখন তোমাদের সাথে সেই কথাগুলো বলতে চাই।
টর জিজ্ঞেস করল, সেই কথাগুলো কী?
আমরা সাতজন মানুষ অত্যন্ত বিপজ্জনক একটা পথ পাড়ি দিচ্ছি, এইমাত্র একটা খুব বড় বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছি। সামনে পাব কিনা জানি না। বিপদ আসবে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এই রকম অসম্ভব বিপজ্জনক অবস্থা হলে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সব সময় সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটি নেয়া যায় না–তার সময় থাকে না। তখন খুব দ্রুত মোটামুটি সঠিক একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেটা খুবই জরুরি।