মস্তিষ্কটি আর্ত চিৎকার করে উঠল, না! লাল চুলের মেয়েটি খিলখিল করে হেসে ওঠে বলল, না? কেন না? এটা হতে পারে না। কিছুতেই হতে পারে না।
মেয়েটি তার পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। এটি আসলেই হতে পারে না। এটি আসলে একটা মিথ্যা ঘোষণা। বিজ্ঞান আকাদেমীর এগারোজন সদস্যকে বিচার করা হবে সেই ঘোষণাটি আসলে সত্যি নয়। কেন সত্যি নয় জান?
না। জানি না।
তার কারণ, আগামীকাল বিকেল তিনটার সময় সবার আগে তাদের বাসায় গিয়ে তাদের হত্যা করা হবে। কে কাকে হত্যা করবে সেটাও ঠিক হয়ে গেছে। আমাদের সর্বাধিনায়ক হত্যা করবে তোমাদের মহামান্য থুলকে! নিজের হাতে। সেই দৃশ্যটি দেখার জন্যে আমার সমস্ত শরীর আকুলি বিকুলি করছে! মেয়েটি অপ্রকৃতস্থের মতো একটা শব্দ করে বলল, আহ্! সেই দৃশ্যটি কী অভূতপূর্ব হবে তুমি চিন্তা করতে পার?
মস্তিষ্কটি কাতর গলায় বলল, আমি চিন্তা করতে চাই না। আমি শুনতে চাই। তোমার দোহাই লাগে–
মেয়েটির শরীরে উত্তেজক পানীয় কাজ করতে শুরু করেছে। সে মাটিতে পা দাপিয়ে বলল, তোমাকে শুনতে হবে হতভাগা মস্তিষ্ক! তোমাকে সব শুনতে হবে। নেটওয়ার্ক দখল করে আমরা কীভাবে সব রবোমানবকে নির্দেশ পাঠাব তোমাকে সেটা শুনতে হবে। কীভাবে অস্ত্রাগারের দরজা খুলে দেয়া হবে সেটা শুনতে হবে। কীভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো দখল হবে শুনতে হবে, কীভাবে শস্যভাণ্ডার দখল হবে শুনতে হবে, কীভাবে সুস্থ সবল মানুষের মাথায় ইমপ্লান্ট বসিয়ে রবোমান তৈরি করব শুনতে হবে।
মস্তিষ্কটি আর্ত চিৎকার করে বলল, শুনতে চাই না! আমি কিছুই শুনতে চাই–দোহাই তোমার–
লাল চুলের মেয়েটি অপ্রকৃতস্থের মতো হাসতে থাকে। কিছুতেই হাসি থামাতে পারে না।
১৬. সাতজনের ছোট দলটি
সাতজনের ছোট দলটি নিঃশব্দে হেঁটে যেতে থাকে। তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোথাও কোনো শব্দ নেই। পৃথিবী হলে এখানে পাখির ডাক থাকত, ঝি ঝি পোকার ডাক থাকত { গাছের পাতার মাঝে বাতাসের শিরশির শব্দ থাকত। দূর থেকে কোনো একজন নিঃসঙ্গ ভবঘুরের গানের সুর ভেসে আসত। এখানে কিছু নেই। ইহিতার কাছে এই নৈঃশব্দটুকু অসহ্য মনে হয়।
ইহিতা দূরে তাকাল। সূর্যটি অস্ত যাচ্ছে, লাল এই গ্রহে দূরে নিপ্রাণ সূর্যটিকে কেমন যেন অপরিচিত মনে হয়। ঠিক পৃথিবীর মতোই খুব ধীরে ধীরে সন্ধ্যে নেমে আসবে। একটু পর ঘুটঘুটে অন্ধকারে ড়ুবে যাবে। মঙ্গল গ্রহের কুৎসিত চাঁদ দুটি আকাশে থাকবে কী না কে জানে, থাকলেই সেটা কতোটুকু আলো দিতে পারবে সেটাই বা কে জানে। শৈশবে এই গ্রহটিকে নিয়ে সে কতো পড়াশোনা করেছে, তখন কী সে কল্পনা করেছিল একটি নির্বোধ কম্পিউটারের কারণে এই গ্রহটিতে নির্বাসিত হয়ে যাবে?
একটি ঢালু পাহাড়ের নিচে এসে সুহা বলল, আমরা এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই। ক্লদ মনে হয় একটু ক্লান্ত হয়ে গেছে।
ক্লদ বলল, উঁহু। আমি ক্লান্ত হই নি। আমি কখনো ক্লান্ত হই না।
ইহিতা বলল, চমৎকার! কিন্তু পরিশ্রম করলে ক্লান্ত হওয়াটা দোষের কিছু নয়। তুমি যদি ক্লান্ত হও, তাহলে আমাদের বল। আমরা তোমাকে ট্রান্সপোর্টারে বসিয়ে নিয়ে যাব। কোনো পরিশ্রম ছাড়াই তখন যেতে পারবে।
টুরান বলল, আমাদের একটা বাই ভার্বাল থাকলে চমৎকার হতো, অনেক তাড়াতাড়ি যেতে পারতাম।
টর দাঁত কিড়মিড় করে বলল, হতভাগা ট্রিনিটি আমাদের ছোট একটা স্কাউটশিপে করে এখানে পাঠিয়েছে, খাবার আর পানি নিয়েই টানটানি, এখানে বাই ভার্বাল কেমন করে পাঠাবে? ৮৪
নীহা আপন মনে তার কুগুরাভ সমীকরণ সমাধান খুঁজে যাচ্ছিল, তার চারপাশে সবাই কে কী বলছে ভালো করে শুনছিল না। হঠাৎ করে সে বলল, আমার অনেকক্ষণ থেকে একধরনের অস্বস্তি হচ্ছে। আমি কেন জানি আমার ভাবনায় মনোযোগ দিতে পারছি না।
কেন?
আমার–আমার—নীহা তার ব্যাকটিকে শেষ না করে থেমে গেল।
ইহিতা জানতে চাইল, তোমার কী?
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, কেউ আমাদের চোখে চোখে রাখছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন আমাদের লক্ষ করছে। কেমন জানি অশুভ একটা অনুভূতি।
সুহা বলল, সেটি হতেই পারে। আমরা সবাই তেজস্ক্রিয় প্রাণীকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে আছি।
নীহা মাথা নাড়ল, বলল, না সেরকম নয়। আমার অনুভূতিটি অনেক বাস্তব। মনে হচ্ছে কেউ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। চারদিকে অন্ধকারমনে হচ্ছে অন্ধকারের বাইরে অনেকগুলো চোখ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
টুরান কষ্ট করে একটু হাসির মতো শব্দ করল, বলল, তেজস্ক্রিয় প্রাণী নিয়ে ভয় আমার ভেতরেও আছে। কিন্তু অশুভ অনুভূতি বা অন্ধকারে চোখ এগুলো তোমার কল্পনা। কারণ তেজস্ক্রিয় প্রাণী যদি কাছাকাছি আসে তাহলে আমাদের মিটারে আমরা রিডিং পাব। এই দেখো এখানে কোনো রিডিং নেই। বলে টুরান
তেজস্ক্রিয়তা মাপার ছোট যন্ত্রটি নীহাকে দেখাল।
ঠিক তখন তেজস্ক্রিয়তা মাপার যন্ত্রটা থেকে হঠাৎ করে কট কট করে এক ধরনের শব্দ হতে থাকে। সবাই বিস্ফারিত চোখে মিটারটির দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে কাটাটি নড়ছে, কিছু আলো জ্বলতে নিভতে থাকে আর শব্দটা দ্রুততর হতে থাকে।
ইহিতা নিচু গলায় বলল, নীহার ধারণা সঠিক। প্রাণীগুলো আমাদের দিকে আসছে।
নীহা আর্ত চিৎকার করে বলল, সর্বনাশ!
সুহা বলল, আমরা কী করব?
ইহিতা বলল, প্রাণীগুলোকে ঠেকানোর চেষ্টা করতে হবে।