সুহা বলল, ঠিক আছে আমি ক্লদকে সরিয়ে নিই। তোমরা দেখ।
ক্লদ বলল, না আমি যাব না। আমি শুনব মানুষটি কী বলছে।
না তুমি শুনবে না।
আমি শুনব।
না। তুমি শুনবে না–বলে সুহা ক্লদকে ধরে সরিয়ে নিল।
সবাই তখন মানুষটির কথা শুনল। কথাগুলো অনেকটা তার দিনলিপির মতো, সে ছাড়াছাড়া ভাবে, বিচ্ছিন্নভাবে বলছে। অনেক কথা বলছে, বেশিরভাগই আতংকের কথা, অসহায়তার কথা। ক্রোধ এবং ক্ষোভের কথা। তারপরও তার কথা থেকে তারা অনেকগুলো জরুরি বিষয় জানতে পারল। এই মানুষগুলো বুদ্ধিমান প্রাণী সৃষ্টির একটা গোপন মিশনে এসেছিল। পৃথিবীর মতো এখানে যেহেতু কোনো জৈব জগৎ নেই তাই প্রাণীটার শক্তির জন্যে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহার করেছে। যে প্রাণীটি তৈরি হয়েছে সেটি সত্যিকার অর্থে বুদ্ধিমান প্রাণী হয় নি। যেহেতু নতুন করে তাদের জন্মানোর কোনো উপায় নেই তাই অন্যভাবে নিজেদের তৈরি করার পদ্ধতি বের করে নিয়েছে। মানুষদের ধরে তাদের শরীর টুকরো টুকরো করে ব্যবহার করছে। পুরো প্রক্রিয়াটা বীভৎস–যারা এই গোপন মিশনে এসেছিল তারা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেছে। যারা পালাতে পারে নি তারা প্রাণীগুলোর হাতে মারা পড়েছে।
যে বিষয়টা সবচেয়ে ভয়ংকর সেটি হচ্ছে তাদের ধ্বংস করা যায় না–গুলি করে বা বিস্ফোরণে শরীরটাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিলেও তারা ছিন্ন ভিন্ন অংশগুলো জুড়ে দিয়ে নতুন করে তাদের তৈরি করে নেয়। তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে শক্তি পায় বলে তাদের কোনো রসদের অভাব নেই। মাটির নিচে দিয়ে এরা সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে, প্রয়োজন না হলে উপরে ওঠে না, সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দ্রুত চলে যেতে পারে।
মানুষটির কাছ থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য পেয়েছে। মানুষের এই আবাসস্থলটি তেজস্ক্রিয় প্রাণীগুলো দখল করে নিলেও এখন থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে একটা খুব সুরক্ষিত আবাসস্থল রয়েছে যেখানে তেজস্ক্রিয় প্রাণী ঢুকতে পারে না। সেখানে কোনোভাবে আশ্রয় নিতে পারলে তারা বেঁচে যাবে।
ভিডি রেকর্ডে মানুষের কথাগুলো শেষ হবার পর সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, টর জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কী করব?
টুরান বলল, করার তো খুব বেশি কিছু নেই। এই আবাসস্থলটা মোটেও নিরাপদ নয়, তাই আমাদের যেতে হবে সুরক্ষিত আবাসস্থলটিতে।
কেমন করে যাব? প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার পথ।
হেঁটে যাওয়া ছাড়া কি অন্য কোনো পথ আছে?
টর মাথা নাড়ল, বলল, নেই।
তাহলে দেরি করে লাভ নেই। চল রওনা দিই।
ইহিতা বলল, আমাদের সাথে চার বছরের একটা শিশু আছে ভুলে যেও।
টুরান বলল, না। আমরা ভুলি নি।
নীহা খানিকটা অনিশ্চিত ভাবে বলল, আমি একটা বিষয় জিজ্ঞেস করতে পারি?
অবশ্যই। ইহিতা বলল, জিজ্ঞেস তো করতেই পার, কিন্তু আমরা কেউ তার উত্তর জানি কী না সেটা অন্য ব্যাপার।
নীহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমরা লক্ষ করেছ আমরা কিন্তু ছোট একটা ঘটনা থেকে আরেকটা ঘটনার মাঝে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা পুরো ব্যাপারটা কখনো দেখছি না।
টর ভুরু কুঁচকে বলল, পুরো ব্যাপারটা কী?
আমরা এই গ্রহে আটকা পড়েছি, আমরা কোনোভাবে মহাকাশযানে ফিরে যেতে পারব না। আগে হোক পরে হোক তেজস্ক্রিয় প্রাণী আমাদের খেয়ে ফেলবে।
টর বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?।
নীহা বলল, আমি বলছি কেউ একজন আমাকে ভবিষ্যতের একটা পরিকল্পনা দেখাও। মিনিট মিনিট করে বেঁচে থাকতে আমার ঘেন্না ধরে গেছে।
ইহিতা নরম গলায় বলল, নীহা! আমরা যে বিষয়টা ভুলে থাকার ভান করছি, তুমি ঠিক সেই ব্যাপারটা টেনে এনেছ। সত্যি কথা বলতে কী আমরা মিনিট মিনিট করে বেঁচে আছি কারণ সেটা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই। আমরা শুধু সময়টা কাটিয়ে যাচ্ছি, এ ছাড়া আর কিছু করার নেই, সেজন্যে।
নীহা বলল, আমি এই পৃথিবীতে কারো কাছে কিছু চাই নি। শুধু নিজের জন্যে একটু সময় চেয়েছিলাম। নিরিবিলি নিজের সাথে একটু সময়। আমি সেটাও পেলাম না। সেজন্যে দুঃখ দুঃখ লাগছে।
তারা যখন কথা বলছে তখন সুহা আর ক্লদও সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, ক্লদ কৌতূহলী চোখে নীহার দিকে তাকিয়ে রইল, সুহা বলল, মানুষকে কখনো আশা ছেড়ে দিতে হয় না।
নীহা বলল, আমি আশা ছেড়ে দিতে চাই না। আমাকে বল, আমি কী নিয়ে আশা করে থাকব? আমি এই অনিশ্চিত অবস্থাটা আর সহ্য করতে পারছি না, মনে হচ্ছে আমাদের ভেতরে যে দুইজন রবোমানব আছে তারা যদি আমাকে গুলি করে মেরে ফেলত তাহলেই বুঝি বেশি ভালো হত! কে রবোমানব? আমাকে মেরে ফেলবে অনুগ্রহ করে?
সবাই নীহাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল, কী বলবে কেউ বুঝতে পারছে না। নীহা ভাঙা গলায় বলল, আমাকে এখানে রেখে তোমরা যাও। আমি বসে কুগুরাভ সমীকরণের সমাধানের কথা চিন্তা করতে থাকি। এক সময় তেজস্ক্রিয় প্রাণী এসে আমাকে খেয়ে সব ঝামেলা চুকিয়ে দেবে! অন্তত আমি যেটা করতে ভালোবাসি সেটা করতে করতে মারা যাব।
এই দীর্ঘ সময়ে নুট নিজে থেকে কখনো একটি কথাও বলে নি। এবার সে এগিয়ে এসে বলল, আমি কী একটা কথা বলতে পারি?
সবাই চমকে ওঠে নুটের দিকে তাকাল।
ইহিতা বলল, নুট! তুমি যে আমাদের সাথে আছ সেই কথাটি আমাদের কারো মাথাতেই আসে না! অবশ্যই তুমি কথা বলতে পারবে। আমরা শুনতে চাই তুমি কী বলবে। কেমন করে বলবে!
নুট ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল, কথা না বলতে বলতে আমি কেমন করে কথা বলতে হয় সেটাই ভুলে গেছি!