সুহা বলল, বাবা, এটা খেলনা না। এটা সত্যিকারের অস্ত্র।
আমি জানি এটা খেলনা না। আমি খুব সাবধানে ধরে রাখব।
উঁহু। বড় না হওয়া পর্যন্ত হাতে অস্ত্র নেয়া নিষেধ।
টুরান তার দিকে একটা ডিটেক্টর এগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি বরং এটা নিতে পার।
এটা কী?
এটা তেজস্ক্রিয়তা মাপার একটা ডিটেক্টর। মঙ্গল গ্রহে পৃথিবী থেকে অনেক তেজস্ক্রিয়তা ফেলা হয়েছে। আমরা যেন ভুল করে কোনো তেজস্ক্রিয় জায়গায় চলে না যাই সেজন্যে এটা আমাদের সাথে রাখতে হবে। আশপাশে তেজস্ক্রিয় কিছু থাকলেই এটা কট কট শব্দ করবে।
হাতে সত্যিকারের একটা অস্ত্র নিতে না পারার দুঃখটা ক্লদের খানিকটা হলেও ঘুচে গেল। সে ডিটেক্টরটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকে দেখতে থাকে কোথাও কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থ পাওয়া যায় কি না।
স্কাউটশিপের গোল দরজা বন্ধ করে সাতজনের দলটা হাঁটতে শুরু করে। স্পেসস্যুটের ভেতর বাতাসের তাপ, চাপ, জলীয় বাষ্পের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে রাখার পরও তারা বাইরের হিমশীতল পরিবেশটুকু অনুভব করে। একধরনের ঝড়ো বাতাস বইছে, মাঝে মাঝেই চারদিকে ধূলায় ধূসর হয়ে যাচ্ছিল তার মাঝে তারা সারি বেঁধে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। স্পেসস্যুটের পোশাকে নানা ধরনের ভারী যন্ত্রপাতি তারপরেও তাদের নিজেদের অনেক হালকা মনে হয়, প্রতিটি পদক্ষেপ দেবার সময় তারা খানিকটা উপরে ওঠে যায়। যদিও তারা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে কিন্তু দেখে মনে হয় লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে।
কতোক্ষণ গিয়েছে জানে না তখন হঠাৎ করে ক্লদের আনন্দধ্বনি শোনা গেল, পেয়েছি! পেয়েছি!
ইহিতা জানতে চাইল, কী পেয়েছ?
তেজস্ক্রিয়তা।
টুরান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায় তেজস্ক্রিয়তা পেয়েছ?
এই তো আমার ডিটেক্টরে। এই দেখ কট কট শব্দ করছে।
সবাই অবাক হয়ে শুনল সত্যিই ডিটেক্টরটা কট কট শব্দ করছে। নীহা ভয় পাওয়া গলায় বলল, আমরা কি ভুল করে কোনো তেজস্ক্রিয় এলাকায় চলে এসেছি?
টুরান মাথা নাড়ল, বলল, না। আমি নিশ্চিতভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি। আশপাশে কোনো তেজস্ক্রিয়তা নেই।
তাহলে এখন কোথা থেকে আসছে?
ইহিতা উপরের দিকে তাকাল, বলল, হয়তো বাতাসে ভেসে আসছে?
টুরান ডিটেক্টরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, না এটা উপর থেকে আসছে। এটা নিচে থেকে আসছে।
হঠাৎ করে ডিটেক্টরের শব্দ বেড়ে যেতে শুরু করে। সাথে সাথে তারা পায়ের নিচে একটা কম্পন অনুভব করে।
মাটির নিচে দিয়ে কিছু একটা তাদের দিকে আসছে। সবাই তাদের অস্ত্র হাতে তুলে নিল।
কম্পনের সাথে সাথে এবার তারা সামনে পাথরের মাঝে কিছু একটা নড়ে যেতে দেখল। মাটির নিচে দিয়ে কিছু একটা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের মনে হতে থাকে যে কোনো মুহূর্তে পাথর ভেদ করে কিছু একটা ভয়ংকর চিৎকার করে বের হয়ে আসবে, কিন্তু কিছু বের হলো না। তাদের পায়ের নিচে দিয়ে সেটা ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল। ডিটেক্টরে তেজস্ক্রিয়তার শব্দটা কমতে কমতে এক সময় মিলিয়ে গেল।
সুহা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, এটা কী?
ইহিতা বলল, কোনো একটা প্রাণী।
মঙ্গলগ্রহে প্রাণী আছে?
আগে ছিল না। মনে হচ্ছে এখন আছে।
কাছে এলে তেজস্ক্রিয়তা বেড়ে যায় কেন?
নিশ্চয়ই শক্তি পায় তেজস্ক্রিয়তা থেকে। এটা যেহেতু তেজস্ক্রিয় পদার্থের ভাগাড়, শক্তিটাও এখান থেকে পাবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? তেজস্ক্রিয়তার শক্তি অনুপরমাণুকে ছিন্নভিন্ন। করে দিতে পারে। এই প্রাণীর দেহ তাহলে কী দিয়ে তৈরি?
এটা নিশ্চয়ই আমাদের পরিচিত প্রাণীর মতো না। অন্যরকম।
কীভাবে অন্যরকম?
জানি না। হয়তো প্রাণী আর যন্ত্রের একটা হাইব্রিড।
টুরান বলল, এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে চল অগ্রসর হই। চার দেওয়াল আর ছাদের নিচে থাকলে মনে হয় একটু ভরসা পাব।
হ্যাঁ চল।
সবাই আবার অগ্রসর হতে থাকে। ক্লদ জিজ্ঞেস করল, মঙ্গল গ্রহের প্রাণীটা দেখতে কেমন হবে?
সুহা বলল, আমি জানি না। জানতেও চাই না। সেটা যেন আমরা কোনোদিন জানতে না পারি।
ক্লদ বলল, আমি কিন্তু জানতে চাই।
কেউ তার কথার উত্তর দিল না। সবার জীবনই যদি একটা শিশুর জীবনের মতো সহজ সরল হত তাহলে মন্দ হত না!
১৩. কুগুরাভ সমীকরণের দ্বিতীয় সমাধানটা
কুগুরাভ সমীকরণের দ্বিতীয় সমাধানটা নীহার মাথায় আসি আসি করেও আসছিল না। কমপ্লেক্স প্লেনের কোথায় সমাধানটি হবে বোঝা যাচ্ছে, সমাধানটির ক্ষেত্রটিও পেয়ে গেছে শুধু সমাধানটি পাচ্ছে না। নীহা গভীরভাবে চিন্তা করে নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল হঠাৎ করে সে বাস্তব জগতে ফিরে এল। কেউ একজন তাকে ডাকছে, নীহা। কোথায় যাচ্ছ তুমি? দাঁড়াও।
নীহা দাঁড়াল, কুগুরাভ সমীকরণের কথা চিন্তা করতে করতে সে কখন সবাইকে ছেড়ে একা একা খানিকটা দূরে চলে এসেছে লক্ষ করে নি। নীহা শুনল, টর বলছে, আমরা পৌঁছে গেছি।
কোথায় পৌঁছে গেছি?
যেখানে পৌঁছানোর কথা। মানুষের আবাসস্থল।
মানুষ কী আছে?
না। মানুষের থাকার কথা নয়। মঙ্গলগ্রহে এখন আমরা কয়জন ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই।
নীহা হেঁটে হেঁটে অন্যদের কাছে ফিরে এল। জিজ্ঞেস করল, মানুষের আবাসস্থলটা কোথায়?
টর হাত দিয়ে সামনের একটা পাথরের স্তৃপকে দেখিয়ে বলল, এইতো, এটা।
নীহা বলল, দেখে মোটেই মানুষের আবাসস্থল মনে হচ্ছে না।
টর হাতে ধরা মডিউলটা দেখে বলল, মনে না হলেও কিছু করার নেই। এটাই সেই জায়গা। মনে হয় মাটির নিচে তৈরি করেছে।