এখন কী ঘটবে? প্রশ্নটা করতে গিয়ে ছেলেটার গলার স্বর একটু কেঁপে উঠল।
মেয়েটি একটু হাসল, বলল, আমি তোমার মাথার খুলিটা কেটে তোমার মস্তিষ্কটা বের করে নেব। আমার ব্যাগে একটা ক্রায়োজেনিক প্যাকেট আছে, সেটাতে করে নিয়ে যাব। তোমার মস্তিষ্কটা নষ্ট হবে না, তার সাথে আমরা একটা ইন্টারফেস তৈরি করব, তারপর আমরা সেখান থেকে তোমার সব তথ্য বের করে নেব।
ছেলেটি হতবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল, কাঁপা গলায় বলল, তুমি এরকম একটা কাজ করতে পারবে?
কেন পারব না? এটা আমার জন্যে খুব সহজ একটা কাজ। তুমি জান আমরা মানুষ না আমরা হচ্ছি রবোমানব। মানুষের যে দুর্বলতাগুলো আছে সেগুলো সরানোর জন্যে আমাদের জন্ম হয়েছে। আমাদের মাঝে অপ্রয়োজনীয় কোনো অনুভূতি নেই। আমাদের মাঝে ভালোবাসা নেই, মমতা নেই, অপরাধবোধ নেই, দুঃখবোধ নেই। তুমি যেভাবে একটা গণিতের সমস্যার সমাধান কর আমি ঠিক সেভাবে তোমার খুলি কেটে তোমার মস্তিষ্ক বের করে নিই।
কথা শেষ করে মেয়েটি ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল। ছেলেটি অবাক হয়ে আবিষ্কার করল সেই হাসিটি একজন মমতাময়ী মানবীর মতো নরম এবং কোমল।
কয়েক ঘণ্টা পর নিরাপত্তাবাহিনীর দুইজন মানুষ ছেলেটির মৃতদেহটি সমুদ্রের বালুবেলায় একটি ঝাউগাছের নিচে আবিষ্কার করে। একজন নিচু হয়ে মৃতদেহটি পরীক্ষা করে বলল, মাথার খুলি কেটে মস্তিষ্কটি নিয়ে গেছে।
অন্যজন বলল, নিখুঁত কাজ। এক ফোটা রক্তও পড়ে নি।
প্রথমজন বলল, মৃতদেহটি কীরকম বিবর্ণ দেখেছ? শরীরের সব রক্ত বের করে নিয়েছে।
অন্যজন কোনো কথা বলল না। তারা জানে রবোমানবের দেহটি জৈবিক। সেটাকে রক্ষা করতে তাদেরকে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হয়। রবোমানবেরা জানে মানুষের রক্ত খুব ভালো প্রোটিন।
০২. বিজ্ঞান আকাদেমীর সভাপতি মহামান্য থুল
বিজ্ঞান আকাদেমীর সভাপতি মহামান্য থুল তার জন্যে আলাদা করে রাখা উঁচু চেয়ারটিতে বসার পর আকাদেমীর অন্য দশজন সদস্য তাদের চেয়ারে বসল। কালো গ্রানাইটের গোল টেবিলটা ঘিরে চেয়ারগুলো রাখা, টেবিলটা খুব বড় নয়; যেন সবাই সবাইকে কাছে থেকে দেখতে পায় আর কোনোরকম মাইক্রোফোন ছাড়াই তারা যেন খালি গলায় কথা বলতে পারে। ঘরটির দেয়াল ধবধবে সাদা, ছাদটা অনেক উঁচু, সেখান থেকে হালকা নরম একটা আলো ছড়িয়ে পড়ছে। বশাল একটা হলঘরের মাঝখানে গ্রানাইটের কালো টেবিল আর কয়টি চেয়ার, এ ছাড়া আর কোনো আসবাবপত্র নেই।
ঘরের একমাত্র দরজাটি নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত মহামান্য থুল অপেক্ষা করলেন, তারপর আকাদেমীর সকল সদস্যদের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, আমি প্রথমেই তোমাদের সবার কাছে ক্ষমা চাইছি।
কম বয়সী গণিতবিদ শ্রুম বলল, তার কোনো প্রয়োজন নেই মহামান্য থুল।
তাকে বাধা দিয়ে মহামান্য থুল বললেন, আছে। এই ঘরের আমরা এগারোজন হচ্ছি পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এগারোজন মানুষ। পৃথিবীর মানুষ এই টেবিলকে ঘিরে বসে থাকা এই এগারোজনকে পৃথিবী পরিচালনার দায়িত্ব দয়েছে। আমাদের পরস্পরকে বিশ্বাস করতে হবে। আমরা যদি একজন আরেকজনকে বিশ্বাস না করি তাহলে এই আকাদেমী একটা অর্থহীন জটলায় পরিণত হবে। আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছি যে আমি তোমাদের অবিশ্বাস করেছি। আমি তোমাদের সবার লোবোগ্রাফ করিয়ে এই ঘরে ঢুকতে দিয়েছি।
পদার্থবিদ ক্রন বলল, আমরা বুঝতে পারছি মহামান্য থুল। আপনার জায়গায় আমাদের কেউ থাকলেও সেও এই সময়ে ঠিক এই কাজটি করত। পৃথিবীর এখন অনেক বড় দুঃসময়।
মহামান্য থুল একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি জানি তোমরা আমার শংকাটুকু বুঝতে পারবে। তারপরেও আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। তবে আমি তোমাদের জানাতে চাই আমি নিজেও নিজের লোবোগ্রাফি করে এই ঘরে ঢুকেছি। মহামান্য থুল হাতের স্বচ্ছ কাগজটি টেবিলে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এটি আমার রিপোর্ট। আমি দেখেছি, তোমরাও দেখতে পার। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি এই ঘরে যারা আছে তারা সবাই মানুষ। আমিও মানুষ। এখানে কোনো রবোমানব নেই।
জীববিজ্ঞানী ত্রানা বলল, আমরা আপনার কথা বিশ্বাস করছি মহামান্য থুল।
না। মহামান্য থুল মাথা নেড়ে বললেন, আমি তোমাদের সবার রিপোর্ট দেখেছি। তোমাদেরও আমার রিপোর্টটি দেখতে হবে। আমরা সভা শুরু করার আগে সবাই নিশ্চিত হতে চাই যে এই চার দেওয়ালের ভেতর কোনো রবোমানব নেই। সবাই নিশ্চিত হতে চাই যে আমরা সবাই মানুষ।
বিজ্ঞান আকাদেমীর দশজন সদস্যের কেউ হাত বাড়িয়ে রিপোর্টটি নিতে রাজি হল না। সমাজবিজ্ঞানী লিহা বলল, মহামান্য থুল, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আমাদের কারো পক্ষে সেটি করা সম্ভব নয়। আপনার লোবোগ্রাফি রিপোর্ট দেখে আপনার মনুষত্ব যাচাই করার মতো ধৃষ্ঠতা দেখানোর দুঃসাহস এই
পৃথিবীতে কারো নেই।
মহামান্য থুলের মুখে এক ধরনের কাঠিন্য ফুটে উঠল, সেটি তার চরিত্রের সাথে পুরোপুরি বেমানান। তিনি কঠিন গলায় বললেন, তাহলে আমার উপর আরোপিত ক্ষমতাবলে আমি আদেশ করছি, লিহা, তুমি লোবোগ্রাফি রিপোর্টটি দেখে আমাদের সকল সদস্যদের সেটি জানাও।
লিহা অত্যন্ত কুণ্ঠার সাথে রিপোর্টটি হাতে নিয়ে সেটি খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ে মাথা তুলে বলল, এই রিপোর্টে মহামান্য থুলের জিনেটিক কোডিং নির্দিষ্ট করা আছে, এখানে লেখা আছে রবোমানবের বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনোটিই তার শরীরে পাওয়া যায় নি। তিনি সুনির্দিষ্টভাবে একজন মানুষ।