টুকন চিৎকার করে বলল, মঙ্গলগ্রহে?
হ্যাঁ মঙ্গলগ্রহে।
তুমি কী জান মঙ্গলগ্রহ হচ্ছে পৃথিবীর ভাগাড়। মানুষ যখন পুরোপুরি সভ্য হয় নি তখন ভয়ংকর পরীক্ষাগুলো করেছে মঙ্গলগ্রহে? এখানে রয়েছে তেজস্ক্রিয়তা, রয়েছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। শুধু তাই না এখানে জৈবিক পরীক্ষা হয়েছে। নতুন প্রাণ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। এরকম ভয়ংকর একটা জায়গায় আমাদের পাঠাবে?
হ্যাঁ। ট্রিনিটি শান্ত গলায় বলল, আমার কোনো উপায় নেই। আমি যখন জেনেছি তোমাদের দুজন রবোমানব এবং কোন দুজন রবোমানব আমার জানা নেই তখন এছাড়া আমার কিছু করার নেই। একটি কম্পিউটার হিসেবে আমাকে কোনো মানুষকে হত্যার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। যদি দেয়া হতো তাহলে শীতলঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় সাতজনকেই হত্যা করে আমি নিশ্চিত হয়ে যেতাম।
টর বিড়বিড় করে বলল, ভাগ্যিস ক্ষমতা দেয়া হয় নি। ক্ষমতা ছাড়াই তুমি যা ইচ্ছে তাই করতে পার।
ইহিতা বলল, ট্রিনিটি, তুমি কী বলছ সেটা চিন্তা করেছ?
চিন্তা প্রক্রিয়াটি মানুষের। আমি মানুষ নই, তাই চিন্তা করতে পারি না। তবে যে কোনো বিষয় আমি আমার মতো বিশ্লেষণ করতে পারি। কাজেই আমি যেটা বলেছি সেটা অনেক ভাবে বিশ্লেষণ করে বলেছি।
না। ইহিতা মাথা নাড়ল, তুমি পুরোপুরি বিশ্লেষণ কর নি। তুমি বলেছ মানুষকে হত্যা করার ক্ষমতা তোমাকে দেয়া হয় নি। কিন্তু যদি আমাদের ভয়ংকর বাস-অযোগ্য মঙ্গলগ্রহে পাঠিয়ে দাও আমরা কিন্তু সবাই মারা যাব। রবোমানব আর সাধারণ মানুষ সবাই মারা যাব। কাজেই তুমি আসলে আমাদের হত্যাই করছ।
ট্রিনিটি গমগমে গলায় বলল, তোমার বক্তব্য সঠিক নয়। মঙ্গলগ্রহে অনেকবার মানুষ এসেছে গেছে। এখানে তারা অনেক এক্সপেরিমেন্ট করেছে। এখানে অনেক জায়গায় মানুষের পরিত্যক্ত আবাসস্থল আছে, সেখানে খাবার আছে, রসদ আছে। তোমরা ইচ্ছে করলেই একরম একটি দুটি আবাসস্থল খুঁজে বের করে সেখানে আশ্রয় নিতে পার। সেখানে তোমরা মানুষেরা এবং রবোমানবেরা নিজেদের মাঝে বোঝাপাড়া করে নিতে পারবে।
টুরান বলল, আমরা সেই বোঝাঁপড়া এখানে বসে করতে পারি।
ট্রিনিটি বলল, না।
ইহিতা বলল, এটি সরাসরি আমাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া।
ট্রিনিটি বলল, আমার কিছু করার নেই।
সুহা হাহাকার করে বলল, আমার সাথে একটি ছোট শিশু। একটা নিরাপদ জীবনের জন্যে আমি ছোট শিশুকে নিয়ে বের হয়েছি। আমাদের এই বিপদের মাঝে ঠেলে দিয়ো না।
ট্রিনিটি বলল, স্কাউটশিপটা প্রস্তুত করে রাখা আছে। তোমরা সেখানে ওঠো।
নীহা অবাক হয়ে বলল, এখনই?
হ্যাঁ। এখনই।
আমরা যদি রাজি না হই।
ট্রিনিটি বলল, অবশ্যই রাজি হবে। টরকে জিজ্ঞেস করে দেখো আমার প্রস্তাবে রাজি না হয়ে থাকা সম্ভব কী না!
ইহিতা বলল, আমাদের পুরো ব্যাপারটি ভেবে দেখার সময় দিতে হবে। আমরা মানুষ, এই মহাকাশযানটির নেতৃত্ব আমাদের দেয়া হয়েছে। তুমি একটা কম্পিউটার, তোমায় আমাদের সাহায্য করার কথা। আমাদের আদেশ নির্দেশ মেনে চলার কথা। আমাদের পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে দাও, ভাবনা-চিন্তা করতে দাও।
তোমরা মানুষ—এবং রবোমানব, শুধুমাত্র এই কারণে আমি তোমাদের ভাবনা-চিন্তা করতে দেব না। তার কারণ তোমরা এমন কোনো একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলতে পারবে যার কারণে আমি তোমাদের রেখে দিতে বাধ্য হব। আমি সেরকম পরিস্থিতিতে যেতে রাজি নই। তোমরা স্কাউটশিপে উঠে যাও।
ঘরের ভেতরে যারা আছে তারা সবাই একে অপরের দিকে তাকাল। সুহা কাতর গলায় বলল, তোমাদের ভেতর যে রবোমানব সে নিজের পরিচয় দিয়ে দাও। দোহাই তোমাদের। আমাদের সবাইকে মেরে ফেলো না?
নীহা বলল, রবোমানবদের বুকের ভেতর কোনো ভালোবাসা থাকে না। তারা তোমার কথাকে কোনো গুরুত্ব দেবে না। তারা একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছে। সেই উদ্দেশ্য সফল না হওয়া পর্যন্ত তারা এখান থেকে যাবে না।
ট্রিনিটি গমগমে গলায় বলল, তোমরা স্কাউটশিপে উঠে যাও। এক মিনিটের মাঝে স্কাউটশিপে উঠে না গেলে আমি জোর করতে বাধ্য হব।
ক্লদ জিজ্ঞেস করল, মা, আমরা স্কাউটশিপে করে কোথায় যাব? মঙ্গলগ্রহে। ক্লদের মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, কী মজা হবে। তাই না মা?
সুহা অসহায়ভাবে একবার ক্লদের মুখে আরেকবার সবার মুখের দিকে তাকাল। ট্রিনিটি আবার বলল, দশ সেকেন্ড পার হয়ে গেছে। আর পঞ্চাশ সেকেন্ড বাকি আছে।
সবাই পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল। ট্রিনিটি বলল, আর চল্লিশ সেকেন্ড।
সবার আগে ইহিতা ওঠে দাঁড়াল। তার দেখাদেখি অন্য সবাই। ইহিতা ফিসফিস করে বলল, ট্রিনিটি, তুমি মানুষ হলে আমি তোমাকে অভিশাপ দিতাম। কিন্তু তুমি একটি নির্বোধ কম্পিউটার, তোমাকে অভিশাপ দেয়া অর্থহীন। তবু আমি অভিশাপ দিচ্ছি। তুমি যেন মানুষের হাতে ধ্বংস হও।
ট্রিনিটি বলল, পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড।
১২. স্কাউটশিপটি গর্জন করতে করতে
স্কাউটশিপটি গর্জন করতে করতে নিচে নামতে থাকে। যতদূর দেখা যায় বিস্তৃত লালাভ একটি গ্রহ, লালচে মেঘ, নিচে প্রবলবেগে ধূলিঝড় বয়ে যাচ্ছে।
স্কাউটশিপটির তীব্র ঝাকুনি সহ্য করতে করতে নীহা বলল, মঙ্গল গ্রহ সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ এর ভর পৃথিবীর দশভাগের এক ভাগ, ব্যাসার্ধ পৃথিবীর অর্ধেক। তাই এখানে আমাদের ওজন হবে সত্যিকার ওজনের মাত্র তিনভাগের এক ভাগ।
টুরান বলল, যতক্ষণ মঙ্গলগ্রহে থাকব সারাক্ষণ আমাদের বায়ুনিরোধক পোশাক পরে থাকতে হবে। সেটি অত্যন্ত বিশেষ ধরনের পোশাক, তার ওজন দিয়ে আমাদের ওজন একটু বাড়ানো হবে, তারপরেও আমাদের সবসময়ই নিজেদের হালকা মনে হবে।