ক্যাপসুলের ভেতর টুক করে একটা শব্দ হল, সঙ্গীতটি বন্ধ হয়ে গেছে। ভেতরে একটা সবুজ আলো জ্বলে উঠেছে। টুরান তার হাতটি চোখের সামনে নিয়ে এল, তার শরীরে শক্তি ফিরে এসেছে। সে হাত দিয়ে ক্যাপসুলের ঢাকনাটি স্পর্শ করতেই সেটা নিঃশব্দে খুলে গেল। টুরান সাবধানে ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এসে ক্যাপসুলের পাশে দাঁড়াল। সে দাঁড়াতে পারছে, ভেসে যাচ্ছে না যার অর্থ মহাকাশযানটি তার অক্ষের উপর ঘুরছে, মহাকাশযানের মাঝে কৃত্রিম একটা মাধ্যাকর্ষণ তৈরি করে রাখা আছে।
টুরান মাথা ঘুরিয়ে ডানদিকে তাকাতেই সে চমকে ওঠে। মহাকাশযানের দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে ইহিতা বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
বসার ভঙ্গিটি দুঃখি মানুষের মতো, দেখে মনে হয় কিছু একটা নিয়ে ইহিতা গভীর বিষাদে ড়ুবে আছে। টুরান জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
কিছু হয় নি।
তুমি এমন করে বসে আছ কেন?
আমি তো এমন করেই বসি।
টুরান বলল, আমরা কেপলার টুটুবিতে পৌঁছে গেছি, মানুষের নতুন সভ্যতা শুরু করব, তোমার মাঝে তার উত্তেজনা দেখছি না।
আমরা কেপলার টুটুবিতে পৌঁছাই নি। আমাদের যাত্রা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
টুরান চমকে ওঠে বলল, কী বলছ তুমি?
আমরা সৌরজগতের ভেতরেই আছি।
টুরান উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, কেন? আমাদের যাত্রা কেন বন্ধ করে দেয়া
হল?
ইহিতা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি না। ট্রিনিটি কিছু বলতে রাজি হচ্ছে না। যখন সবাই জেগে উঠবে তখন বলবে তার আগে বলবে না।
অন্যদের কখন জাগাবে? তোমাকে কেন আগে জাগিয়েছে?
আমাকে আগে জাগায় নি, সবাইকে একই সাথে জাগানো শুরু করেছে। একেকজনের শরীর একেকভাবে কাজ করে তাই একেকজন একেক সময়ে জেগে উঠছে।
টুরান হেঁটে হেঁটে অন্য ক্যাপসুলগুলোর কাছে যায়, ভেতরে কী হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করে আবার ইহিতার কাছে ফিরে এসে বলল, আমার কাছে পুরো ব্যাপারটি খুব দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে।
ইহিতা কথাটার কোনো উত্তর দিল না। টুরান তখন বলল, আমার কাছে মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু ঘটেছে। খুব খারাপ এবং ভয়ংকর।
সেটি কী হতে পারে?
আমি জানি না।
সবাই ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর ট্রিনিটি সবাইকে একটা ছোট হলঘরে নিয়ে এলো। ঘরটিতে বসার জন্যে কার্যকর চেয়ার, চেয়ারের সামনে ডেস্ক এবং ডেস্কে ধূমায়িত খাবার। ক্লদ ছাড়া আর কেউ সেই খাবারে উৎসাহ দেখাল না।
টুরান বলল, ট্রিনিটি, তুমি ভূমিকা ছেড়ে দিয়ে সোজাসুজি কাজের কথায় চলে এসো।
ট্রিনিটি বলল, আমি আসলে ভূমিকা করছি না। সোজাসুজি কাজের কথায় চলে এসেছি। আমি তোমাদেরকে একটি দুঃসংবাদ দেবার জন্যে ডেকে তুলেছি।
কেউ কোনো কথা না বলে দুঃসংবাদটি শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। ট্রিনিটি ভাবলেশহীন গলায় বলল, পৃথিবীটি রবোমানবেরা দখল করে নেবে সেই আশংকায় এই মহাকাশযানে করে তোমাদের সাতজনের নেতৃত্বে বিশালসংখ্যক মানুষ, মানুষের দ্রুণ, জিনোম, পশুপাখি, গাছপালা পাঠানো হচ্ছিল। এর উদ্দেশ্য মানুষ দূর মহাকাশের কোনো একটি উপযুক্ত গ্রহে বসতি স্থাপন করবে। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের কথা কিছুক্ষণ আগে পৃথিবী থেকে আমাকে জানানো হয়েছে তোমাদের সাতজনের মাঝে দুইজন রবোমানব।
ক্লদ ছাড়া অন্য সবাই ভয়ানক চমকে উঠল। ক্লদ ঠিক সেই মুহূর্তে তার খাবারের মাঝে একটা লাল চেরি আবিষ্কার করেছে। সে এটা খাবে না কি এটা দিয়ে খেলবে সেটি নিয়ে মনস্থির করতে পারছিল না।
টুরান কাঁপা গলায় বলল, কোন দুইজন?
আমি জানি না। পৃথিবীর মানুষও জানে না। এটি জানলে পুরো ব্যাপারটা খুব সহজ হয়ে যেতো।
সবাই সবার দিকে তাকাল, চোখে চোখ পড়তেই আবার তারা নিজেদের দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ইহিতা জিজ্ঞেস করল, আমাদের ভেতর যারা রবোমানব তারা নিজেরা কী জানে যে তারা রবোমানব?
রবোমানবের মস্তিষ্কের থ্যালামাসে একটা অত্যন্ত ক্ষুদ্র ইমপ্ল্যান্ট বসানো হয় যেটা মস্তিষ্ককে পরিবর্তন করে, ওভার ড্রাইভ করে। তোমাদের দুজনের সেই ইমপ্লান্ট কার্যকর করা হয়ে থাকলে তোমরা ইতোমধ্যে জান যে তোমরা রবোমানব।
ইহিতা জানতে চাইল, সেটা কী কার্যকর করা হয়েছে?
আমি জানি না। এই মহাকাশযানে সেটা পরীক্ষা করার উপায় নেই।
নীহা জিজ্ঞেস করল, এখন কী করা হবে? আমরা কী আবার পৃথিবীতে ফিরে যাব?
না। ট্রিনিটি কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, তোমাদের সাতজনকে এই মহাকাশযান ছেড়ে চলে যেতে হবে।
সবাই চমকে উঠল, সুহা আর্তচিৎকার করে বলল, কী বলছো!
আমি কী বলেছি তোমরা সেটি শুনতে পেয়েছ, তারপরেও আমি আবার বলি। তোমাদের এই সাতজনকে মহাকাশযান ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমার এই মহাকাশযানের নিরাপত্তার জন্যে এখানে কোনো রবোমানবকে স্থান দেয়া যাবে না।
সুহা হাহাকারের মতো শব্দ করে বলল, আমরা কোথায় যাব? আমি আমার এই শিশু বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় যাব?
ক্লদ এই ছোট হলঘরের ভেতরের উত্তেজনাটুকু টের পেতে শুরু করেছে। সে তার খাওয়ার প্যাকেটটি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে কী হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল।
ট্রিনিটি বলল, আমরা পৃথিবী থেকে খুব বেশিদূর যাই নি। গ্রহাণু বেল্ট পার হয়েছি মাত্র। গতিপথ পরিবর্তন করে আমি মহাকাশযানটিকে মঙ্গলগ্রহ ঘিরে একটি কক্ষপথে নিয়ে এসেছি। তোমাদের একটা স্কাউটশিপে করে আমি মঙ্গলগ্রহে পাঠিয়ে দিচ্ছি।