সবাই মাথা নাড়ল, বলল, না। ঠিক না।
০৯. তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ
তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?
কোনো উত্তর নেই। লাল চুলের মেয়েটি মাথা ঝাঁকিয়ে গলার স্বর আরেকটু উঁচু করে বলল, শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?
এবারেও কোনো উত্তর নেই। লাল চুলের মেয়েটি খিল খিল করে হেসে বলল, আমি জানি তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ, তুমি ইচ্ছে করে আমার কথার উত্তর দিচ্ছ না। কেন আমার কথার উত্তর দিচ্ছ না? তুমি কী আমার উপরে রাগ করেছ?
না আমি রাগ করিনি। যে মানুষটির দেহ নেই, হাত পা মুখ চোখ কিছু নেই, যার অস্তিত্ব হচ্ছে শুধু একটা মস্তিষ্ক সে রাগ করতে পারে না।
চমৎকার। তোমার আর আমার সম্পর্কটি তাহলে ভালোবাসার সম্পর্ক! মধুর একটি ভালোবাসার সম্পর্ক!
আমি তোমার নিষ্ঠুরতা দেখে হতবাক হয়ে যাই। কী বলতে চাও বল। আলোহীন বর্ণহীন শব্দহীন গন্ধহীন অনুভূতিহীন আমার শূন্য জগৎটি ভয়ংকর। এর চাইতে ভয়ংকর কিছু হতে পারে না। কিন্তু তুমি প্রতিদিন আমার সাথে দুইএক মিনিট যে কথাগুলো বল সেটি সেই শূন্যতার জগৎ থেকেও ভয়ংকর। বল তুমি কী বলতে চাও। বলে আমাকে মুক্তি দাও।
আমি তোমাকে একটা সুসংবাদ দিতে চাই।
সুসংবাদ?
হ্যাঁ। সুসংবাদ।
কী সুসংবাদ? শুনতে আমার আতংক হচ্ছে। কিন্তু তুমি বল।
আর আটচল্লিশ ঘণ্টার মাঝে আমরা নেটওয়ার্ক দখল করে নেব। তখন পুরো পৃথিবীটা হবে আমাদের।
তোমরা পুরো পৃথিবীটা নিয়ে কী করবে?
লাল চুলের মেয়েটি খিল খিল করে হেসে বলল, এটি আবার কীরকম প্রশ্ন? মানুষ পৃথিবীটা দখল করে কী করেছে?
মানুষ তো পৃথিবী দখল করে নি! মানুষ সবাইকে নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থেকেছে। একেবারে ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে বিশাল নীল তিমিসবাইকে নিয়ে বেঁচে থেকেছে। তার কারণ মানুষের বেঁচে থাকার একেবারে গোড়ার কথা হচ্ছে ভালোবাসা! তোমাদের তো ভালোবাসা নেই–তোমরা কী নিয়ে বেঁচে থাকবে? তোমরা কেন বেঁচে থাকবে?
লাল চুলের মেয়েটি খিল খিল করে হাসতে হাসতে বলল, আমরা কেমন করে বেঁচে থাকি সেটা দেখানোর জন্যেই আমি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখব! বুঝেছ?
মস্তিষ্কটি উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল লালচুলের মেয়েটি খুট করে সুইচটি বন্ধ করে দিল। কাচের জারে ভেসে থাকা থলথলে মস্তিষ্কটির দিকে তাকিয়ে তার এক ধরনের ঘৃণাবোধ হয়। সে হেঁটে হেঁটে জানালার কাছে দাঁড়ায়। দূর পাহাড়ের পিছনে সূর্যটা আড়াল হয়ে যাচ্ছে, চারদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। লালচুলের মেয়েটি বাইরে তাকিয়ে থাকে, তার ভুরু দুটি কুঞ্চিত, কিছু একটা তাকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছে। মস্তিষ্কটি সত্যিই জিজ্ঞেস করেছে, পৃথিবী দখল করে তারা কী করবে?
সত্যিই তো। তারা কী করবে?
১০. দূর পাহাড়ের দিকে
বিজ্ঞান আকাদেমীর সভাপতি মহামান্য থুল দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়েছিলেন, তার পাশে তথ্যবিজ্ঞানী জুহু দাঁড়িয়ে আছে। সূর্যটা পাহাড়ের আড়ালে চলে যাবার সাথে সাথে চারদিকে আবছা অন্ধকার নেমে আসে।
মহামান্য থুল নিচু গলায় বললেন, যতক্ষণ সূর্য আকাশে থাকে ততক্ষণ একটিবারও মনে হয় না সেটি আড়াল হয়ে গেলে অন্ধকার নেমে আসবে।
তথ্যবিজ্ঞানী জুহু কী বলবে বুঝতে না পেরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। মহামান্য থুল মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের হাতে আর কতোক্ষণ সময় আছে?
সময় নেই। রবোমানবেরা ইচ্ছে করলে এখন যে কোনো মুহূর্তে নেটওয়ার্ক দখল করে নিতে পারে। তারা করছে না, অনুমান করছি তারা আরো একটু গুছিয়ে নিতে চাইছে।
তার মানে আমাদের হাতে খুব বেশি হলে আটচল্লিশ থেকে বাহাত্তর ঘণ্টা সময়।
জুহু বলল, কিংবা আরো কম!
নেটওয়ার্কটি দখল করে নেবার পর কী হবে বলতে পারবে?
সবার আগে আমাদের এগারোজনকে খুন করবে।
তারপর?
তারা পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের সকল তথ্য পেয়ে যাবে। যত প্রতিষ্ঠান আছে তা নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে। পানি, বিদ্যুৎ, খাবার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করবে। চিকিৎসার নিয়ন্ত্রণ নেবে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করবে। এক সময় পৃথিবীতে বিশাল অস্ত্র ভাণ্ডার ছিল, এখন নেই। যদি থাকত তাহলে সবার আগে তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতো।
তারপর কী করবে বলে তোমার ধারণা?
পৃথিবীর সবচেয়ে কর্মক্ষম মানুষগুলোকে ধরে নিয়ে যাবে।
হত্যা করার জন্যে?
ভয় দেখানোর জন্যে প্রথমে নিশ্চয়ই অনেক মানুষকে হত্যা করবে। তারপর তারা কর্মক্ষম মানুষগুলোকে রবোমানবে পাল্টে দিতে শুরু করবে।
তারপর?
তারপর ধীরে ধীরে পৃথিবীর সব মানুষকে রবোমানবে পাল্টে দেবে। কেউ কেউ হয়তো পালিয়ে পাহাড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেবে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ রবোমানব হয়ে যাবে। নেটওয়ার্ক দিয়ে নিখুঁতভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে।
তারপর?
জুহুকে একটু বিভ্রান্ত দেখা গেল। ইতস্তত করে বলল, পৃথিবীর সব মানুষকে রবোমানবে পাল্টে দেয়ার পর কী আর কিছু বাকি থাকল?
নিশ্চয়ই বাকি আছে। তারপর কী হবে বলে তোমার ধারণা?
জুহু কোনো উত্তর দিল না।
রবোমানব বাবা-মায়ের রবোমানব সন্তান হবে পরের প্রজন্ম?
নিশ্চয়ই তাই হবে।
মহামান্য থুল খুব ধীরে ধীরে ঘুরে জুহুর দিকে তাকালেন, বললেন, তোমার ধারণা মানুষের মায়েরা যেভাবে তাদের সন্তানদের ভালোবেসে বুক আগলে রক্ষা করে রোমানবের মায়েরাও তাই করবে? যে ভালোবাসাকে তাদের মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে সন্তানের জন্যে সেই ভালোবাসা আবার ফিরে আসবে?