ক্লদের ক্যাপসুলের ঢাকনাটি নেমে এসে ক্যাপসুলটি বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে অন্য সবাই একট আর্ত চিৎকার শুনতে পায়। ইহিতা চমকে ওঠে বলল, কী হয়েছে?
ট্রিনিটি বলল, টরকে শীতলঘরে আনছি। ছোট একটা ইলেকট্রিক শক দিয়েছি।
ইহিতা কঠিন গলায় বলল, তুমি আমাদের একজন অভিযাত্রীকে ইলেকট্রিক শক দিতে পার না।
পারি। শুধু ইলেকট্রিক শক নয়, আরো অনেক কিছু করতে পারি। এই মহাকাশযানটি আমার দায়িত্বে। এটি ঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্যে আমাকে অনেক কিছু করতে হয়।
আমি ভেবেছিলাম একটি কম্পিউটার কখনো একজন মানুষকে অত্যাচার করতে পারে না। তাদেরকে সেই অধিকার দেয়া হয় নি।
ঠিক তখন আবার একটা ভয়ংকর আর্ত চিৎকার শুনতে পেল, আগের থেকে জোরে এবং আগের থেকে দীর্ঘ সময়ব্যাপী। প্রায় সাথে সাথেই সবাই দেখতে পেল টর বাতাসে ভেসে ভেসে দ্রুত এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে। ঘরের দরজায় সে আঘাত খেয়ে পিছনে ছিটকে গেল এবং দেয়াল আঁকড়ে ধরে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সে ঘরের ভেতরে ঢুকে পাগলের মতো নিজের ক্যাপসুলটি খুঁজতে থাকে। তার চোখ-মুখ রক্তশূন্য, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বিকৃত এবং কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দুই হাতে নিজের কান চেপে ধরে সে তার ক্যাপসুলে হুঁড়মুড় করে ঢুকে বড় বড় শ্বাস নিতে থাকে। ইহিতা ক্যাপসুলে মাথা ঢুকিয়ে টরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে টর?।
টর বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল, কানের ভেতর ভয়ংকর শব্দ, মনে হয় মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। কী ভয়ানক যন্ত্রণা তুমি চিন্তা করতে পারবে না!
এখন বন্ধ হয়েছে?
হ্যাঁ বন্ধ হয়েছে। টর হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলল, আমি এই ট্রিনিটিকে খুন করে ফেলব। সৃষ্টিকর্তার দোহাই, খুন করে ফেলব।
ট্রিনিটি একটা কম্পিউটার! কম্পিউটারকে খুন করবে কেমন করে?
সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও!
টর কথা শেষ করার আগেই ক্যাপসুলের দরজাটি নেমে আসে। ইহিতা মৃদু স্বরে বলল, কাজটা ঠিক হল না।
নীহা জানতে চাইল, কোন কাজটা?
আমরা এখনো আমাদের যাত্রা শুরু করিনি এর মাঝে ট্রিনিটির সাথে টরের বিরোধ!
ট্রিনিটি গমগমে গলায় বলল, তোমরা সেটা নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমার সাথে কারো বিরোধ নেই।
ইহিতা বলল, না থাকলেই ভালো। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, চল আমরা আমাদের ক্যাপসুলে ঢুকে যাই।
নীহা বলল, চল।
সবাই যখন নিজের ক্যাপসুলে ঢুকছে তখন ইহিতা দেখল নুট তার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ইহিতা অবাক হয়ে বলল, নুট! কিছু বলবে?
নুট মাথা নাড়ল। ইতিহা জিজ্ঞেস করল, কী বলবে?
নুট মৃদু গলায় ফিসফিস করে বলল, আমার খুব ভয় করছে।
কিসের ভয়?
শীতলঘরে ঘুমানোর পর যদি আর কখনো জেগে না উঠি!
ইহিতা নুটের হাত ধরে বলল, জেগে উঠবে। নিশ্চয়ই জেগে উঠবে।
তুমি আমাকে কথা দিচ্ছ?
ইহিতা একমুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, হ্যাঁ। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি। যাও ক্যাপসুলে শুয়ে পড়।
নুট তার ক্যাপসুলে যেতে যেতে আবার ফিরে এসে ইহিতার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, তোমার যদি কিছু করার জন্যে কখনো সাহায্যের দরকার হয় তুমি আমাকে বল। তুমি যেটা বলবে আমি সেটা করব।
ইহিতা হেসে বলল, অবশ্যই বলব নুট। অবশ্যই বলব।
ক্যাপসুলের ঢাকনাটা নেমে আসার সাথে সাথে ইহিতা একটা মিষ্টি গন্ধ অনুভব করতে পারল। তাদেরকে ঘুম পাড়ানোর জন্যে সম্ভবত কোনো একটি গ্যাস ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ইহিতা সামনে রাখা মনিটরটা স্পর্শ করে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি পৃথিবীটাকে শেষবার দেখতে চাই।
মনিটরে ধীরে ধীরে নীল পৃথিবীটার ছবি ভেসে উঠল। এই অপূর্ব সুন্দর নীল গ্রহটি ছেড়ে সে চলে যাবে? আর কখনো এই গ্রহটি সে দেখতে পাবে না? তাদের নতুন গ্রহ কেপলার টুটুবি দেখতে কেমন হবে? পৃথিবীর মতো সুন্দর?
গভীর একটা বেদনায় তার বুক টনটন করতে থাকে। ইহিতা অনুভব করে খুব ধীরে ধীরে অপূর্ব নীল গ্রহটি আবছা হয়ে আসছে। তার চোখে ঘুম নেমে আসছে। ঘুম। গভীর ঘুম।
কতো বছর পর তার এই ঘুম ভাঙবে?
০৮. ছোট ঘরটির ধাতব টেবিল ঘিরে
ছোট ঘরটির ধাতব টেবিল ঘিরে বারোজন নারী পুরুষ বসে আছে, দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এরা সবাই রবোমানব। কঠিন চেহারার মানুষটি টেবিলে থাবা দিতেই সবাই তার দিকে তাকাল। সে একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, আগে যতবার এই ঘরটিতে তেমাদের নিয়ে বসেছি, প্রত্যেকবার আমার ভেতরে এক ধরনের চাপা ভয় কাজ করেছে। যদি মানুষেরা খবর পেয়ে যায়–যদি তারা আমাদের ধরতে চলে আসে! মানুষটি তার আঙুল দিয়ে টেবিলে একটু শব্দ করে বলল, এই প্রথমবার আমার ভেতরে কোনো ভয় নেই। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে নেটওয়ার্কটি এখনো দখল করি নি, কিন্তু নেটওয়ার্কটির গুরুত্বপূর্ণ সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে চলে এসেছে। এখন হঠাৎ করে নিরাপত্তাবাহিনীর কেউ আর আমাদের ধরতে চলে আসবে না!
লালচে চুলের মেয়েটি বলল, তোমাকে অভিনন্দন!
আমাকে অভিনন্দন দেবার কিছু নেই। আমরা সবাই মিলে করেছি।
কিন্তু তোমার নেতৃত্বে করেছি। তুমি অসাধারণ একটি পরিকল্পনা করেছ। নেটওয়ার্কে যখন প্রথমবার তোমার ছবি আর নামটি চলে আসবে, যখন সবাই জানবে নতুন পৃথিবীর নতুন নেতা তুমি-তখন পৃথিবীর গোবেচারা মানুষগুলোর কী অবস্থা হবে কল্পনা করেই আমার শরীরে শিহরণ হতে থাকে!
কঠিন চেহারার মানুষটি হাসি হাসি মুখে বলল, তোমার শিহরণকে আর দুটি দিন আটকে রাখ। এখন থেকে ঠিক দুইদিন পর আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে নেটওয়ার্ক দখল করব।