ইহিতা ভুরু কুঁচকে বলল, গুরুত্বপূর্ণ কথা তাহলে কেমন করে বলতে হয়।
টুরান কাঁধ ঝাকুনি দিয়ে বলল, আমার গুরুত্বপূর্ণ কিংবা হালকা কোনো ধরনের কথাই বলতে ইচ্ছে করছে না।
ইহিতা কিছুক্ষণ স্থির চোখে টুরানের দিকে তাকিয়ে রইল, কথা বলার প্রস্তাবটি আমি না দিয়ে যদি একজন পুরুষমানুষ দিত তাহলে কী তুমি আরেকটু আগ্রহ নিয়ে কথা বলতে?
সম্ভবত।
ইহিতা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, টুরান। তোমার ব্যক্তিগত জীবনের একটা ঘটনাকে তুমি এই মহাকাশযানের এতো বড় একটা অভিযানে টেনে আনবে আমি সেটা বিশ্বাস করি নি।
টুরান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি দুঃখিত। কিন্তু আমার কিছু করার নেই।
টর একটু এগিয়ে এসে বলল, ঠিক আছে, টুরানের যদি আগ্রহ না থাকে থাকুক। আমরা অন্যেরা তোমার গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো শুনি।
ইহিতা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমরা তো যন্ত্র নই। আমরা মানুষ। মানুষের কাছে মানুষের গুরুত্বপূর্ণ কথা মাত্র একটিই হতে পারে।
টুরানের মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে, সেটি কী? একজনের জন্যে অন্যজনের সহমর্মিতা।
টুরান এবার হাসির মতো শব্দ করল, বলল, সহমর্মিতা অনেক কঠিন শব্দ। আমরা না হয় সেটি ব্যবহার না করলাম। তাছাড়া এই ধরনের শব্দ আমি বিশ্বাস করি না।
টর বলল, টুরান, তুমি কেন ইহিতাকে কথা বলতে দিচ্ছ না?
ইহিতা বলল, সত্যি কথা বলতে কী, আমার মনে হয় আমার আর কথা বলার প্রয়োজন নেই। আমরা এখন আমাদের শীতলঘরে যাই। যাবার আগে সবার জন্যে শুভেচ্ছা। আমরা আবার যখন জেগে উঠব, সেটি হবে আমাদের জন্যে নতুন জীবন।
নীহা বলল, আমি সেই নতুন জীবনের জন্যে অপেক্ষা করে আছি।
সুহা বলল, তোমরা আমার সন্তানটির জন্যে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করো যেন তাকে আমি একটি সুন্দর জীবন দিতে পারি।
নীহা বলল, নিশ্চয়ই পারবে সুহা। নিশ্চয়ই পারবে।
ইহিতা নুটের দিকে তাকিয়ে বলল, নুট, তুমি কখনো কোনো কথা বল না। আজকে কী বলবে?
নুট জোর করে হাসার চেষ্টা করে মাথা নাড়ল, সে বলবে না। ৪২
ঠিক আছে, নুট। আশা করছি ভবিষ্যতে কখনো আমরা তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাব!
টুরান বলল, চল আমরা শীতলঘরে যাই। আমি এই অতীতকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পিছনে ফেলে যেতে চাই।
টর বলল, আমি কী ঠিক করেছি জান? কী?
আমি শীতলঘরে ঢুকব না। আমি বাইরে কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে বসে থাকব। আমি মহাকাশযানটির গতিবিধি দেখতে চাই।
হঠাৎ করে ট্রিনিটির কণ্ঠস্বর গমগম করে ওঠে, না টর। সেটি সম্ভব নয় তোমাকে শীতলঘরে ঢুকতে হবে।
আমি ঢুকব না। আমি মানুষ, আমি একটা কম্পিউটারের নির্দেশ মানতে রাজি নই।
টর। আমি তোমার সাথে তর্ক করতে চাই না। একটা মহাকাশযানের মূল কম্পিউটার হিসেবে আমার অনেক ক্ষমতা। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমি তোমাকে শীতলঘরে যেতে বাধ্য করতে পারি।
কীভাবে?
আমি তোমাকে সেটি বলব না। তুমি যদি আমার কথা না শোনো আমি তোমাকে বাধ্য করতে পারব। আমার সেই ক্ষমতা আছে।
টর কঠোর মুখে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, ট্রিনিটি, আমি তোমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। আমাকে বাধ্য কর।
ট্রিনিটি বলল, সেটি না করলেই ভালো করতে। বিশ্বাস কর আমি অনেক কিছু করতে পারি।
টর মুখ শক্ত করে বলল, আমি বিশ্বাস করি না!
ঠিক আছে, আমি তাহলে অন্যদের বলছি। তোমরা শীতল ঘরে যাও, প্রস্তুতি নাও।
টুরান ইতস্তত করে বলল, আর টর?
ট্রিনিটি বলল, সেও আসবে। তোমরা সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না।
টুরান বলল, আমার মনে হয় আমরা নিজেদের মাঝে একটা বোঝাঁপড়া করে নিতে পারতাম। আমাদের মাঝে কাউকেই নেতৃত্বের দায়িত্ব দেয়া হয় নি। আমরা সেটা করে নিতে পারতাম, তাহলে এই ঝামেলাটুকু হত না।
ইহিতা বলল, একটু আগে আমি সেই প্রস্তাবটি করেছিলাম তখন তুমি রাজি হও নি। এখন তুমি নিজে এই প্রস্তাবটি করছ।
টুরান মুখ শক্ত করে বলল, দুটি আসলে এক বিষয় নয়।
ইহিতা ভেসে ভেসে সামনে অগ্রসর হতে হতে বলল, দুটি আসলে একই বিষয়। তুমি সেটা খুব ভালো করে জান।
টুরান কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, সে স্বীকার করতে চাইছে না কিন্তু এই মেয়েটি আসলে সত্যি কথাই বলেছে।
ট্রিনিটি গমগমে গলায় বলল, উপরে যে ঘরটিতে সবুজ বাতি জ্বলছে তোমরা সবাই সেখানে যাও। সবার জন্যে আলাদা করে একটা ক্যাপসুল রাখা আছে। তোমরা সেখানে ঢুকে যাও। টরকে নিয়ে তোমরা চিন্তা করো না। আমি নিশ্চিতভাবে বলছি, সেও চলে আসবে। সম্ভবত তোমাদের আগেই সে ক্যাপসুলে ঢুকে যাবে।
প্রথমে ক্লদ, তার পিছু পিছু তার মা সুহা, তাদের পিছনে পিছনে ইহিতা নুট আর নীহা, সবশেষে টুরান উপরের ঘরটিতে এসে ঢুকল। দেয়ালের সাথে সাতটি ক্যাপসুল লাগানো, ক্যাপসুলের ওপর ছোট স্ক্রিনে তাদের ছবি। সবাই নিজের ক্যাপসুল খুঁজে বের করে নেয়। ক্লদ আনন্দের শব্দ করে বলল, আমার ক্যাপসুলটি কতো সুন্দর দেখেছ, মা?
সুহা বলল, হ্যাঁ বাবা খুব সুন্দর।
ভেতরে ভিডি রিডার আছে।
হ্যাঁ। তুমি খেলতে পারবে। আমাদের সাথে কথা বলতে পারবে।
আমি ভিতরে ঢুকি?
ঢুকে যাও। ঢুকে যাবার আগে শুধু আমাকে একটু আদর দিয়ে যাও।
ক্লদ তার মাকে একবার জড়িয়ে ধরল। সুহা গভীর মমতায় শিশুটিকে ক্যাপসুলের ভেতর শুইয়ে দেয়। আবার তার সাথে কবে দেখা হবে সে জানে। কত বছর পার হয়ে যাবে? একশ বছর? দুইশ বছর? নাকি লক্ষ বছর?