নীহা জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?
কণ্ঠস্বরটি তরল গলায় বলল, আমি তো আর তোমাদের মতো মানুষ নই যে আমার একটা নাম কিংবা পরিচয় থাকতে হবে। কিন্তু তোমরা যদি চাও আমাকে ট্রিনিটি নামে ডাকতে পার। ট্রিনিটি নামটি আমার খুব পছন্দের।
নীহা বলল, ট্রিনিটি, তোমার সাথে পরিচয় হয়ে খুব খুশি হলাম।
ধন্যবাদ নীহা।
তুমি আমার নাম জান?
শুধু নাম? আমি তোমার সবকিছু জানি। সত্যিকথা বলতে কী আমি তোমার সম্পর্কে এমন অনেক কিছু জানি যেটা তুমি নিজেই জান না!
সেটা কীভাবে সম্ভব?
খুবই সম্ভব। তুমি ইরিত্রা রাশিমালার যে সমস্যাটা নিয়ে চিন্তা করছ, তুমি যে তার সমাধানের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছ, তুমি কী সেটা জান? জান না। আমি জানি।
কী আশ্চর্য!
এটা মোটেও আশ্চর্য কিছু নয়। আমার জন্যে এটা খুবই সোজা। তোমাদের সবার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার ওপর, আমি তোমাদের সবসময় চোখে চোখে রাখি। তোমাদের শরীরের ভেতরে এমনকি মস্তিষ্কের ভেতরেও আমি উঁকি দিতে পারি!
কী আশ্চর্য! নীহা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে আবার বলল, কী আশ্চর্য!
সুহা চোখের কোনা দিয়ে ক্লদকে দেখার চেষ্টা করছিল, সে তখন মহাকাশযানের এক অংশে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বিপজ্জনকভাবে অন্যদিকে ছুটে যাচ্ছে। সুহার চোখে মুখে আতংকের একটা ছায়া পড়ল, মনে হয় সেটা দেখেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার ট্রিনিটি তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল, সুহা! তুমি চিন্তা করো না। আমি তোমার ছেলে ক্লদকে চোখে চোখে রাখছি! তার কিছু হবে না।
সত্যি?।
সত্যি। সে চেষ্টা করলেও নিজেকে ব্যথা দিতে পারবে না। আমাদের এই মহাকাশযানের নিরাপত্তার ব্যবস্থার খুঁটিনাটি জানলে তুমি হতবাক হয়ে যাবে।
তোমার সাথে কথা বলেই আমি হতবাক হয়ে যাচ্ছি।
স্কাউটশিপে করে আসা ক্রুদের একজন বলল, ট্রিনিটি। আমরা কী আনুষ্ঠানিকভাবে তোমার কাছে এই মহাকাশচারীদের দায়িত্ব দিয়ে ফিরে যেতে পারি?
অবশ্যই পার। তোমার তথ্য ক্রিস্টালটি আমার ভিডি রিডারে প্রবেশ করিয়ে দাও। আমি তখন আনুষ্ঠানিকভাবে সাতজন মহাকাশচারীর দায়িত্ব নিয়ে নেব।
মধ্যবয়স্ক ক্রুটি তার পিঠে ঝোলানো ব্যাগ থেকে চতুষ্কোণ একটি ক্রিস্টাল বের করে কন্ট্রোল প্যানেলের নির্দিষ্ট জায়গায় ঢুকিয়ে দিল। কিছুক্ষণ একধরনের যান্ত্রিক শব্দ হল, প্যানেলে কিছু আলোর ঝলকানি হল তারপর ক্রিস্টালটি আবার বের হয়ে এলো। সবাই আবার তখন ট্রিনিটির কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, চমৎকার! ছয়জন পূর্ণবয়স্ক মানুষ এবং একজন শিশুর দায়িত্ব আমি নিয়ে নিচ্ছি। এই সাতজন মানুষ ছাড়াও শীতলঘরে আরো অসংখ্য মানুষ, প্রাণী, বৃক্ষলতা, তাদের দ্রুণ এবং তথ্য রয়েছে আমি সেগুলোর দায়িত্বও নিয়ে নিচ্ছি।
মধ্যবয়স্ক ক্রুটি কন্ট্রোল প্যানেল থেকে চতুষ্কোণ ক্রিস্টালটি বের করে সাবধানে নিজের ব্যাগে রেখে বলল, তাহলে আমরা বিদায় নিই?
ট্রিনিটি বলল, হ্যাঁ তোমাদের বিদায় নেয়ার সময় হয়ে গেছে। আমি যখন আমার সবগুলো কুরু ইঞ্জিন চালু করব তখন তোমাদের স্কাউটশিপ নিয়ে এই মহাকাশযান থেকে দূরে থাকা ভালো, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভেতর ঢুকে যাওয়া উচিত।
চারজন ক্রু তাদের যন্ত্রপাতি বাক্সে ঢুকিয়ে নিয়ে বিদায় নেবার জন্যে প্রস্তুত হল। মধ্যবয়স্ক ক্রু, একটু এগিয়ে এসে একজন একজন করে সাতজন মহাকাশচারীর সবার হাত স্পর্শ করল, তারপর বলল, তোমরা কারা, কেন তোমরা এই মহাকাশযানে এসেছ, তোমরা কোথায় যাবে, কতদিনের জন্য যাবে, কেন যাবে আমরা কেউ সেগুলো কিছু জানি না। আমাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তোমাদের এই মহাকাশযানে এনে ট্রিনিটির হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে। আমরা সেই দায়িত্ব শেষ করে তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি।
টুরান বলল, আমরা কারা কেন কোথায় যাচ্ছি তার সবকিছু আমরা জানি, কিন্তু আমাদের সেই কথাগুলো কাউকে বলার কথা নয়, তাই তোমাদেরকেও বলছি না–
মধ্যবয়স্ক ক্রু বলল, আমরা সেটি নিয়ে কোনোরকম কৌতূহল দেখাচ্ছি না! কিন্তু আমরা জানি তোমাদের এই মিশন মানবজাতির জন্যে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ, আমরা তোমাদের সাফল্য কামনা করি।
তোমাদের ধন্যবাদ।
অন্য তিনজন ক্রু এগিয়ে এসে সবার হাত স্পর্শ করে বিদায় নিয়ে মহাকাশযানের গোল দরজা দিয়ে ভেসে ভেসে বের হয়ে গেল। গোল দরজাটা বন্ধ হয়ে যাবার পর তারা একটা মৃদু গর্জন এবং কম্পন অনুভব করে। একটু পরেই স্বচ্ছ জানালা দিয়ে তারা স্কাউটশিপটাকে নীল আলো ছড়িয়ে ছুটে যেতে দেখে।
টুরান তখন অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল, এখন থেকে আমরা একা। একেবারে একা।
ইহিতা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। আমাদের জন্যে ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করে আছে আমরা জানি না। যদি কখনো সিদ্ধান্ত নিতে হয় আমাদের নিজেদেরই নিতে হবে।
নীহা বলল, ট্রিনিটি আমাদের সাহায্য করবে।
টুরান মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। অবশ্যই। ট্রিনিটি অবশ্যই আমাদের সাহায্য করবে।
ইহিতা বলল, আমাদের কিছুক্ষণের মাঝে শীতলঘরে ঢুকে যেতে হবে, কতোদিন সেখানে আমরা থাকব জানি না। আবার কখন সবার সাথে দেখা হবে বলতে পারি না। আমার তাই মনে হয় শীতলঘরে যাবার আগে নিজেদের মাঝে একটু কথা বলে নিই। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা।
টুরান কন্ট্রোল প্যানেলের একটা মনিটর ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, আমাদের ভরশূন্য পরিবেশে থাকার অভ্যাস নেই। এভাবে ভেসে ভেসে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা সোজা নয়।