আমরা কী তখন মস্তিষ্ক একটুও ব্যবহার করতে পারব না?
থুল হাসলেন, বললেন, তুমি চেষ্টা করে দেখ পার কিনা। না পারলেও ক্ষতি নেই, কারণ তুমি যে চিন্তাটি করতে করতে শীতল ঘরে ঘুমিয়ে পড়বে, ঘুম ভাঙবে ঠিক সেই চিন্তাটি নিয়ে। তুমি জানতেও পারবে না তার মাঝে হয়তো কয়েকশ বছর কেটে গেছে।
নীহা বলল, আমি এই অভিজ্ঞতাটুকু পাওয়ার জন্যে আর অপেক্ষা করতে পারছি না।
তোমাকে আর বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না। মহামান্য থুল আবার সবার দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, আর কোনো প্রশ্ন আছে?
সবাই মাথা নাড়ল, জানাল তাদের আর কোনো প্রশ্ন নেই। থুল এবারে মুটের দিকে তাকিয়ে বললেন, নুট, সবাই কিছু না কিছু বলেছে। তুমি এখনো কিছু বল নি। তুমি কি কিছু জিজ্ঞেস করবে?।
নুট নিঃশব্দে মাথা নেড়ে জানাল সে কিছু জিজ্ঞেস করবে না। মহামান্য থুল তখন উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, তোমাদের সাথে আমার কিংবা পৃথিবীর কোনো মানুষের সাথে সম্ভবত আর কখনো দেখা হবে না। আমি তোমাদের জন্যে শুভ কামনা করছি।
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে একবার আলিঙ্গন করে ধীর পায়ে হেঁটে হলঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
০৭. স্কাউটশিপটা
স্কাউটশিপটা এক ধরনের ভোতা যান্ত্রিক শব্দ করতে করতে মহাকাশযানের পাশে এসে থামল। স্বয়ংক্রিয় কিছু যন্ত্রপাতি স্কাউটশিপটাকে আঁকড়ে ধরে। মহাকাশযানের গোলাকার দরজার সাথে বায়ুনিরোধক সংযোগটা নিশ্চিত করার পর ঘরঘর শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। বাতাসের চাপটি সমান হবার সময় একটা মৃদু কম্পন অনুভব করা গেল তারপর হঠাৎ করে সবকিছু পুরোপুরি নীরব হয়ে যায়।
সাতজন মহাকাশচারীকে মহাকাশযানে তুলে দেবার জন্যে যে চারজন ক্রু এসেছে তারা স্কাউটশিপের সিট থেকে নিজেদের মুক্ত করে ভাসতে ভাসতে কাজ শুরু করে দেয়। সবাইকে সিট থেকে মুক্ত করে ক্রুরা তাদেরকে খোলা দরজাটি দিয়ে মহাকাশযানের ভেতর নিয়ে আসে। যন্ত্রপাতিগুলো ইতস্তত ভেসে বেড়াচ্ছিল সেগুলোকে মহাকাশযানের গায়ে আটকে দিতে দিতে একজন ক্রু বলল, তোমরা ভারশূন্য পরিবেশটাতে একটু অভ্যস্ত হয়ে নাও, ভবিষ্যতে কাজে দেবে। টুরান একটু সামনে এগুতে যাওয়ার চেষ্টা করে শূন্যে পুরোপুরিভাবে একটা ডিগবাজি খেয়ে বিব্রতভাবে বলল, ট্রেনিংয়ের সময় ভেবেছিলাম বিষয়টা খুব সোজা!
হাসিখুশি চেহারার ত্রুটি মহাকাশযানের এক অংশ থেকে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে অন্য অংশে ভেসে যেতে যেতে বলল, যে কোনো বিষয় অভ্যস্ত হয়ে যাবার পর সোজা। তোমরাও দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে!
ইহিতা মহাকাশযানের দেয়াল ধরে সাবধানে একটু এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে বলল, কিন্তু আমরা তো অভ্যস্ত হবার সুযোগ পাব না। মহাকাশযানটির ভেতরে কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণ বল তৈরি করার জন্যে তোমরা তো একটু পরেই এটাকে তার অক্ষের উপর ঘোরাতে শুরু করবে।
টুরান মহাকাশযানের মাঝামাঝি একটা জায়গায় ঝুলে ছিল, সেখান থেকে সরে যাবার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমাদেরকে একটু পরে শীতলঘরে আটকে দেবে, মাধ্যাকর্ষণ দিয়েছ কী দাও নি সেটা তো আমরা জানতেও পারব না!
মধ্যবয়স্ক একজন ক্রু একটা প্যানেলের সামনে নিজেকে আটকে ফেলে বলল, মহাকাশযানের কক্ষপথে ঠিকভাবে চালিয়ে নিতে মহাকাশযানে একটা কৌণিক ভরবেগ দিতে হয়–মাধ্যাকর্ষণটি আসল উদ্দেশ্য না।
টর ভাসতে ভাসতে খানিকদূর এগিয়ে গিয়ে বলল, আমি এখনো মনে করি আমাদের শীতলঘরে বন্ধ করে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। মহাকাশযানের যাত্রাটা আমাদের উপভোগ করতে দেয়া দরকার।
ইহিতা হেসে বলল, বারো জি ত্বরণে যাওয়ার সময় তুমি সেটা উপভোগ করবে বলে মনে হয় না! স্কাউটশিপেই আমাদের কী অবস্থা হয়েছিল মনে আছে?
টর মহাকাশযানের একটা ভাসমান মডিউলকে ধরার চেষ্টা করে বলল, যেহেতু সত্যিকারের মহাকাশযানে এসেছি একটু বাড়তি উত্তেজনা তো পেতেই পারি।
মহাকাশচারীদের ছোট দলটি যখন ভারশূন্য পরিবেশে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছিল তখন দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ক্লদকে সবার আগে বিষয়টিতে পুরোপুরি অভ্যস্ত হতে দেখা গেল। সে মহাকাশযানের এক দেয়াল থেকে অন্য দেয়ালে রবারের বলের মতো ছুটে যেতে লাগল, এবং তার মুখের আনন্দধ্বনি মহাকাশযানের পরিবেশটুকুকে বেশ অনেকখানি সহজ করে তুলে।
কিছুক্ষণের মাঝে মহাকাশযানের শক্তিশালী কুরু ইঞ্জিন গর্জন করে ওঠে এবং পুরো মহাকাশযানটি কেঁপে ওঠে। মহাকাশযানের ভেতর বাতাসের প্রবাহ শুরু হয়ে যায়। বিশাল মহাকাশযানের নানা অংশে আলো জ্বলে ওঠে এবং অসংখ্য যন্ত্রপাতি গুঞ্জন করে ওঠে।
কয়েকজন ক্রু মহাকাশযানের কন্ট্রোল প্যানেলে কাজ করছিল। তারা এবারে সবাইকে ডাকল, বলল, মহাকাশযানের কোয়ান্টাম কম্পিউটার চালু হয়েছে। তোমরা এসে নিজেদের দায়িত্ব বুঝে নাও।
সুহা বৃথাই তার ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমাদের সবাইকে আসতে হবে? ক্লদকেও?।
মধ্যবয়স্ক ক্রু বলল, ঠিক আছে, ক্লদকে একটু পরে আনলেও হবে। অন্যরা এসো।
দলের বাকি ছয়জন সদস্য ভাসতে ভাসতে কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে এসে দাঁড়ায়। টর জানতে চাইল, কোথায় কোয়ান্টাম কম্পিউটার?
এই যে আমি এখানে। মহাকাশযানের ভেতর একটা কণ্ঠস্বর গম গম করে ওঠে।
টুরান বলল, এখানে মানে কোথায়?
এখানে মানে এই মুহূর্তে এখানে। যদি তুমি অন্য কোথাও থাকো আমি সেখানেও থাকব। আমি এই মহাকাশযানের সবজায়গায় আছি। সবসময়ে আছি।