বলুন। আমাকে আশাহত করে এই গবেট রবোটটি ভঙ্গিতে আমার বক্তব্যের পুরো হেঁয়ালিটুকু এড়িয়ে গেল। আমি অসহায়ভাবে ঢোঁক। এখন কী করি?
ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মাথায় বিদ্যুৎচমকের মতো একটি চমৎকার বুদ্ধি খেলে গেল। যদিও এতক্ষণেও কোনো কিছু করতে না পেরে আমি মোটামুটি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম, তবুও মনের গোপনে একটি আশা ছিল যে আমার মস্তিষ্ক আমাকে প্রতারণা করবে না নিশ্চয়ই। শেষ মুহূর্তে একটা সমাধান বের করে দেবে। সমাধানটি অতি সরল। রবোটটিকে একটি মজার অঙ্ক করতে দিতে হবে। অন্ধটি এত সাধারণ যে, এতক্ষণ মনে হয় নি দেখে আমি বিক্ষিত হলাম।
আমার সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান ঘটেছে। মন হালকা হয়ে গেছে। হাসিমুখে ঠাট্টা করে বললাম, তোমাকে যে—অঙ্কটি করতে দেব, সেটি ভীষণ জটিল।
বেশ তো।
নিখুঁত উত্তর চাই।
বেশি।
অন্ধটি সাধারণ রাশিমালার। যতদূর সম্ভব নিখুঁত উত্তর বলবে।
দশমিকের পর কয় ঘর পর্যন্ত?
যতদূর পার।
অঙ্কটি কি?
আমি হাসি চেপে রেখে বললাম, বাইশকে সাত দিয়ে ভাগ করলে কত হয়?
রবোটটি এক মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা করল। তারপর বলল, তিন দশমিক এক চার দুই আট পাঁচ সাত…
তারপর?
এক চার দুই আট পাঁচ সাত…এক চার…
বলে যাও।
দুই আট পাঁচ সাত এক চার দুই আট…
রবোটটি একটানা বলে যেতে লাগল। আমি মিনিট দুয়েক শুনে নিশ্চিত হলাম যে এটি হঠাৎ থেমে পড়বে না। তারপর ফোন তুলে অফিসের কর্মকর্তকে বললাম, বিদ্যুৎ অপরিবাহী পোশাক-পরা এক জন টেকনিশিয়ান পাঠাতে। রবোটটির পারমাণবিক ব্যাটারি খুলে বিকল করতে হবে। ভদ্রলোক এখুনি পাঠাচ্ছেন বলে ফোন রাখতে গিয়ে বললেন, আপনার ঘরে নামতা পড়ছে কে?
নামতা নয়। আমি হাসলাম, রবোটটি বাইশকে সাত দিয়ে ভাগ করছে।
রবোটটি তখনও বলে চলছে, পাঁচ সাত এক চার দুই আট…
আমি ফোন নামিয়ে রেখে ভাবলাম, ভাগ্যিস বাইশকে সাত দিয়ে ভাগ করলে ভাগ কোনো দিনই শেষ হয় না। ভাগফলে ঘুরে ঘুরে একই সংখ্যা আসতে থাকে। না হলে যে কী উপায় হত।
০৪. কপোট্রনিক ভায়োলেন্স
প্রমিথিউস নামে আমি একটা রবোট তৈরি করেছিলাম। সেটি ছিল পৃথিবীর প্রথম মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট, কিন্তু সে নিয়ে আমি কোনো গর্ব করার সুযোগ পাই নি। সেটি আমার স্ত্রীর প্রেমে পড়েছিল এবং হাস্যকরভাবে কপোট্রনের কন্ট্রোল টিউবে গুলি করে আত্মহত্যা করেছিল। আমি ও আমার স্ত্রী বুলা এই ঘটনাটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম—পৃথিবীতে মাথা ঘামানোর মতো প্রচুর সমস্যা আছে।
ঠিক এই সময়ে আমার কাছে একটি সরকারি চিঠি এল। তাতে লেখা, আমি রবোটকে মানবিক আবেগ দেয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি, একথা যদি সত্যি হয়, তবে সরকার সেটা উপযুক্ত মূল্য দিয়ে কিনে নিতে ইচ্ছুক। জাতীয় পুস্তক প্রকাশনালয়, সিনেমা সেন্সর বোর্ড, সঙ্গীত, শিল্প ও সংস্কৃতি উন্নয়ন প্রকল্প এবং বেসামরিক আদালতে তারা এই ধরনের রবোট ব্যবহার করে মানুষের অনেক অহেতুক পরিশ্রম ও বিতর্কের অবসান ঘটাতে চায়। প্রমিথিউসের কথা কীভাবে তাদের কানে গিয়েছে সেটি প্রশ্ন নয় (নিশ্চিতভাবেই আমি কিংবা বুলা কখনো কাউকে বলে দিয়ে থাকবে), সরকার মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরির পরবর্তী সমস্যা সম্পর্কে কতটুকু অবহিত, তা আমার জানা দরকার। তাদের সাথে আলাপ করে আমি রবোটকে মানবিক আবেগ দেয়ার বিপত্তির সবগুলি সম্ভাবনা দেখিয়ে দিলাম। সরকার তবুও মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরির পরিকল্পনা বাতিল করতে রাজি হল না। আমি বুঝতে পারলাম, শুধু পুস্তক প্রকাশনায়, সিনেমা সেন্সর বা আদালতের বিচারক হিসাবে নয়, এদের অন্য কোনো বৃহত্তর কাজে ব্যবহার করা হবে। সে-কাজটি কী হতে পারে তা আমার ধারণা নেই, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা এই ধরনের কিছু হতে পারে, সরকার সেটি গোপন রাখাই পছন্দ করছে। সরকার আমাকে আশ্বাস দিল যে, আমি যদি মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরির পদ্ধতিটি তাদের কাছে বিক্রয় করি, তারা রবোট তৈরির সময় রবোটে বিশেষ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখবে। প্রেম, ভালবাসা ও মানুষের ক্ষতি সম্বন্ধে তাদের কিছু ভাবার ক্ষমতাই দেয়া হবে না। আমি আংশিক নিশ্চিন্ত হয়ে মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরির পদ্ধতিটি মোটা মূল্যে বিক্রয় করে দিলাম—তখন আমার টাকার ভীষণ দরকার।
এরপর এ বিষয়ে সরকার কী করছে না-করছে খোঁজখবর নিই নি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে তখন প্রথমবারের মতো প্রতি-জগতের অস্তিত্বের উপর একটি সফল পরীক্ষা চালানো হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক রবোট থেকে এটি অনেক কৌতূহলজনক।
বছরখানেক পর আমি আরেকবার সরকারি পত্ৰ পেলাম। তাতে লেখা, প্রথমবারের মতো কিছুসংখ্যক (সঠিক সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই গোপন করা হয়েছে) মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরি করা হয়েছে, তার একটি আমার কাছে পাঠানো হবে। আমি যেন সেটার আচার-আচরণ লক্ষ করে আরও উন্নততর করার কোনো পরিকল্পনা দিতে চেষ্টা করি। প্রমিথিউসকে নিয়ে আমার যে-তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে, এরপর আমার আর কোনো ব্লবোটের সাথে সম্পর্ক রাখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। আমি সরকারি প্রস্তাবটি সোজাসুজি প্রত্যাখ্যান করে দিতে চেয়েছিলাম-কিন্তু জানা গেল সরকারি নির্দেশকে এভাবে অগ্রাহ্য করা যায় না। এর সাথে নাকি দেশ ও জাতির অনেক রকম স্বাৰ্থ জড়িত থাকে।