বলুন।
আমি এখান থেকে বের হতে না পারলে মারা যাব।
জানি।
আমি মারা গেলে এই এক্সপেরিমেন্টটার কোনো মূল্য থাকবে না। আর কেউ এর ফলাফল বুঝতে পারবে না।
জানি।
কাজেই আমাকে বের হতে দাও।
আমাকে বলা হয়েছে। আমি যেন সবচেয়ে কম ঝামেলায় এই পরীক্ষাটি শেষ করি। এর ফলাফল নিয়ে কী করা হবে না-হবে সেটা জানা আমার দায়িত্ব নয়! আমি ভেবে দেখেছি, সবচেয়ে কম ঝামেলা হয় আপনাকে ভিতরে আটকে রাখলে। আপনাকে বের করতে হলে আবার নতুন করে সব শুরু করতে হবে। সেটি সম্ভব নয়, কাজেই আপনি ভিতরেই থাকুন—আপনার মৃত্যুতে খুব বেশি একটা আর্থিক ক্ষতি হবে না।
ইডিয়ট—আমি তীব্র স্বরে গালি দিলাম, সান অব এ বিচ!
আপনি অর্থহীন কথা বলছেন। রবোটটির গলার স্বর একঘেয়ে যান্ত্রিকতায় নিষ্প্রাণ।
আমি ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম। এখন কী করতে পারি? এই বিরাট ল্যাবরেটরির অতিকায় যন্ত্রপাতির ভিতর আমি একান্তই অসহায়। হতাশায় আমি নিজের চুল টেনে ধরলাম।
তক্ষুনি নজরে পড়ল, এক কোণায় ঝোলানো টেলিফোন। ছুটে গিয়ে রিসিভার তুলে নিলাম, হ্যালো, হ্যালো।
কে? প্রফেসর?
হ্যাঁ। আমি ল্যাবরেটরিতে আটকা পড়ে গেছি।
আমরা বুঝতে পেরেছি। আপনাকে বাইরে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু কিছু করতে পারছি না। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে রবোট।।
রবোটের কানেকশন কেটে দাও।
ওটার কোনো কানেকশন নেই—একটা পারমাণবিক ব্যাটারি সোজাসুজি বুকে লাগানো।
সর্বনাশ! তা হলে উপায়?
আমরা দেখি কী করতে পারি। ঘাবড়াবেন না।
রিসিভারটি ঝুলিয়ে রেখে আমি বিভাট্রনে হেলান দিলাম। একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণের ভিতর পরীক্ষাটি শুরু হবে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, আমি মারা যাচ্ছি। রবোটটিকে বিকল করা সম্ভব নয়। রবোটটিকে বিকল না করলে এই পরীক্ষাটি বন্ধ করা যাবে না। আর এই পরীক্ষাটি বন্ধ না হলে আমার মৃত্যু ঠেকানো যাবে না।
সময় ফুরিয়ে আসছে, আমার ঘড়ি দেখতে ভয় করছিল। তবু তাকিয়ে দেখলাম আর মাত্র ছয় মিনিট বাকি। ছয় মিনিট পরে আমি মারা যাব। আমার স্ত্রী বুলা কিংবা ছেলে টোপন জানতেও পারবে না। আর ইঁদুরের মতো ব্যাবরেটরির ভিতর আটকা পড়ে মারা গেছি!
আমার শেষবারের মতো বুলাকে একটা ফোন করতে ইচ্ছে হল। ফোন তুলে ডায়াল করতেই বুলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, হ্যালো।
কে? বুলা?
হ্যাঁ।
শোন—ঘাবড়ে যেও না। আমি একটা ভীষণ বিপদে পড়ে গেছি।
কি? বুলার স্বর কেঁপে গেল।
ল্যাবরেটরিতে আটকা পড়ে গেছি। বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। রবোটটি এত নির্বোধ, আমাকে বের হতে দিচ্ছে না। এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করতেও রাজি নয়। আর ছয় মিনিট পরেই ভয়ানক রেডিয়েশান শুরু হয়ে যাবে। একেবারে সোজাসুজি মারা যাচ্ছি।
বুলা একটা আর্তচিৎকার করল।
কী আর করা যাবে-টোপনকে দেখো। আমার গলা ধরে এল, তবু স্বাভাবিক স্বরে বললাম, বাইরে অবশ্যি সবাই খুব চেষ্টা করছে আমাকে বের করতে। লাভ নেই—
প্ৰাণ-গোন-বুলা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল।
কী?
তোমাদের রবোটটি কী ধরনের?
বাজে। একেবারেই বাজে। পি-টু ধরনের।
যুক্তিতর্ক বোঝে?
বোঝে। তবে তৃতীয় শ্রেণীর লজিক খাটায়।
তা হলে একটা কাজ করে।
কি?
রবোটটিকে বল, আমি মিথ্যা কথা বলছি।
মানে?
বুলার কণ্ঠস্বর অধৈর্য হয়ে ওঠে। কাঁপা কাঁপা গলায় দ্রুত বলল, রবোটটার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বল, আমি মিথ্যা কথা বলছি। অর্থাৎ তুমি বলবে যে তুমি মিথ্যা কথা বলছ।
লাত?
আহা! বলেই দেখি না। দেরি করো না।
আমি ল্যাবরেটরির শেষ ঘরে পৌঁছে আবার ছোট্ট ফুটোটা দিয়ে মাথা বের করলাম। নির্বোধ ধাতব রবোটটি স্থির হয়ে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ডাকলাম, এই, এই রবোট।।
বলুন।
আমি স্পষ্ট স্বরে থেমে থেমে বললাম, আমি মিথ্যা কথা বলছি।
রবোটটি দু-এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, আপনি বলছেন আপনি মিথ্যা কথা বলছেন; কাজেই আপনার এই কথাটি মিথ্যা। অর্থাৎ আপনি সত্যি কথা বলছেন। অথচ আপনি বললেন, আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। অর্থাৎ আপনার এই কথাটিও মিথ্যা। আপনি সত্যি কথাই বলছেন। কিন্তু আপনি বলছেন, আপনি মিথ্যা কথা বলছেন—কাজেই একথাটিও মিথ্যা। আপনি সত্যি কথাই বলছেন। অথচ আপনি মিথ্যা কথা বলছেন…অর্থাৎ সত্যি কথাই বলছেন…মিথ্যা কথা বলছেন…সত্যি কথা বলছেন…
রবোটটি সেইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে একবার বলতে লাগল, আপনি সত্যি কথা বলছেন, পরমুহূর্তে বলতে লাগল, মিথ্যা কথা বলছেন। এই ধাঁধাটি মিটিয়ে না দেয়া পর্যন্ত এটি সারা জীবন এইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বিড়বিড় করে পরস্পরবিরোধী কথা বলতে থাকবে। আমার বুকের ওপর থেকে একটা পাথর নেমে গেল।
ল্যাবরেটরির ভিতরে এসে শুনলাম ঝনঝনি করে ফোন বাজছে। রিসিভার তুলতেই বুলা চেঁচিয়ে উঠল, কী হয়েছে?
চমৎকার। গাধা রবোটটা ধাঁধায় পড়ে গেছে। বুলা, তুমি না থাকলে আজ একেবারে মারা পড়তাম। কেউ বাঁচাতে পারত না।
রিসিভারে শুনতে পেলাম বুলা ঝরঝর করে কেন্দে ফেলল। সত্যি আমি বুঝতে পারি না, আনন্দের সময় মানুষ কেন যে কাঁদে!
বাইরে তখন লেসার বীম দিয়ে ইমার্জেন্সি এক্সিটটি ভাঙা হচ্ছে। রবোটটির ধাঁধা না মেটানো পর্যন্ত ওটা পরীক্ষা শুরু করতে পারবে না। হাতে অফুরন্ত সময়।
আমি বিভাট্রনে হেলান দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। তারপর একটা সিগারেট ধরালাম, এখানে সিগারেট ধরানো সাংঘাতিক বেআইনি জেনেও।
০৩. কপোট্রনিক বিভ্ৰান্তি (দুই)
ল্যাবরেটরির করিডোর ধরে কে যেন হেঁটে আসছিল। পায়ের শব্দ শুনে বুঝরে পারলাম ৫টি একটি রবোট-মানুষের পায়ের শব্দ এত ভারী আর এরকম ধাতব হয় না। অবাক হবার কিছু নেই। এই ল্যাবরেটরিতে সব মিলিয়ে দু শর উপর রবোট কাজ করছে। শুধুমাত্র গাণিতিক বিশেষজ্ঞ রবোটই আছে পঞ্চাশটি। এ ছাড়া যান্ত্রিকবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, পরমাণুবিষয়ক বিদ্যা ইত্যাদি তো রয়েছেই। এরা বিভিন্ন প্রয়োজনে অহরহ এখান থেকে সেখানে হেঁটে বেড়াচ্ছে। মানুষের মতো সাবলীল ভঙ্গিতে লিফট বেয়ে উঠে যাচ্ছে, সিঁড়ি বেয়ে নামছে, দরজা খুলে এ-ঘর থেকে সে-ঘরে কাজ করছে। কাজেই করিডোর ধরে কোনো রবোট যদি হেঁটে আসে, তাতে অবাক হবার কিছু ছিল না। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছিলাম। এই রবোটটির বিশেষ ধরনের পায়ের শব্দ শুনে। প্রতিটি পদশব্দ হবার আগে একটা হাততালি দেবার মতো শব্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল প্রতিবারই মেঝেতে পা রাখার আগে রবোটটি একবার করে হাতে তালি দিয়ে নিচ্ছে। আমি ভারি অবাক হলাম।