পুরান দিনের রিভলবার। প্রচণ্ড শব্দ হল। ফটো টিউব গুড়িয়ে প্রমিথিউসের মাথা দুলে উঠল। কতকগুলো পরপর বিস্ফোরণ ঘটল। কালো ধোঁয়া আর পোড়া গন্ধ প্রমিথিউসের ফুটো চোখ দিয়ে বেরিয়ে এল। মাথাটা একটু কান্ত করে এক চোখ দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল প্রমিথিউস। তার সবুজ চোখ খুব ধীরে ধীরে শীতল নিষ্প্রভ হয়ে উঠল।
প্রমিথিউসের মৃত যান্ত্রিক দেহ ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বুলার হাত ধরে বেরিয়ে এলাম। অনুভব করলাম, আমার হাতের ভিতর বুলার হাত থরথর করে কাঁপছে।
আমার বুকের ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, প্রিয়জন হারালে যেরকম হয়। আমার অবাক লাগিছিল, একটা যন্ত্রের জন্যে এরকম কষ্ট পাওয়া কি উচিত?
০২. কপোট্রনিক বিভ্ৰান্তি (এক)
ঘরঘর করে ধাতব দরজাটি নেমে এসে আমাকে ল্যাবরেটরির ভৌতিক কক্ষে আটকে ফেলল। বের হবার অনেক কয়টি দরজা আছে, সেগুলি খোলা না থাকলেও প্রবেশপথে সুইচ প্যানেলের সামনে অপেক্ষমাণ রবোটটিকে বললেই আমাকে বের করে দেবে। কিন্তু তবুও কেন জানি আমার মনে হল আমি খুব বিপদে পড়ে গেছি। আর দশ মিনিটের ভিতরে এই ল্যাবরেটরি-কক্ষে যে অস্বাভাবিক পরীক্ষাটি চালানো হবে, তাতে যো-পরিমাণ তেজস্ক্রিয় রশ্মি বের হবে তার লক্ষ ভাগের এক ভাগ একটি শক্তিশালী ঘোড়াকে এক সেকেণ্ডের ভিতর মেরে ফেলতে পারে। কাজেই দশ মিনিটের আগেই আমাকে এখান থেকে বেরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে হবে। আমি ইমার্জেন্সি এক্সিট দিয়ে বের হবার জন্যে ল্যাবরেটরির অন্য পাশে চলে এলাম। দশ মিনিটের এখনো অনেক দেরি, কিন্তু আমি একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। লক্ষ কালাম, ইমার্জেন্সি এক্সিটের হ্যান্ডেল ধরার সময় আমার হাত অল্প কাঁপছে।
হ্যান্ডেলে চাপ দেয়ার পূর্বমূহুর্তে আমার মনে হল দরজাটি খোলা যাবে না। কেন মনে হয়েছিল জানি না, এরকম মনে হওয়ার পিছনে কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু যখন বারবার হ্যান্ডেল ঘুরিয়েও দরজাটি খুলতে পারলাম না, তখন কেন জানি মোটেই অলাক হলাম না। মৃত্যুভয় উপস্থিত হলে হয়তো অবাক হওয়া বা দুঃখিত হওয়ার মতো সহজ অনুভূতিগুলি থাকে না। আমি লাভ নেই জেনেও ল্যাবরেটরির সব কয়টি দরজা ধাক্কা দিয়ে দেখলাম। পরীক্ষাটি বিপজ্জনক, তাই এগুলি অনেক আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমার ধারণা হয়েছিল, ইমার্জেন্সি এক্সিটটি সত্যিকার ইমার্জেপির সময় ব্যবহার করতে পারব, কিন্তু এখন দেখছি। এটিও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
ল্যাবরেটরির মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি মাথা ঠাণ্ড করার চেষ্টা করলাম। ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছি—কোনো উপায় নেই, মারা যাচ্ছি-এই ধরনের চিন্তা, হতাশা আর আতঙ্ক আমাকে স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে দিচ্ছিল না। আমি নিজেকে বোঝালাম, হাতে খুব কম সময়, এখান থেকে বের হতে না পারলে মারা যাব, আর বের হতে হলে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। আমার মনে হল রবোটটিকে বুঝিয়ে বললে আমাকে বের করে দেবে। এখনো রবোটকে কিছু না বলেই হতাশ হয়ে যাবার কোনো অর্থ নেই।
আমি কয়েকটা মোড় ঘুরে ল্যাবরেটরির শেষ ঘরটিতে পৌঁছলাম। এখানে একটি ছোট্ট ফুটো আছে। সেদিক দিয়ে মাথা বের করে পাশের ঘরে তাকানো যায়। পাশের ঘরটিতেই একটি অতিকায় রবোট একরাশ সুইচের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার কাছে টিকস্-টিক টিকস্-টিক করে একটা ইলেটনিক ঘড়ি সময় ঘোষণা করে যাচ্ছে। প্ৰতি তিন সেকেণ্ড পরপর একটা লাল আলো বিলিক করে। সারা ঘরকে আলোকিত করছিল। সব কিছু ছাপিয়ে একটা মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। আমি উচ্চৈঃস্বরে ডাকলাম
এই, এই রবোট। রবোটটির নাম আমার মনে নেই। সেটি মাথা তুলে তাকাল। বলল, কি?
আমি গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। বললাম, আমি ভিতরে আটকা পড়ে গেছি। ইমার্জেন্সি দরজাটা খোল তো।
সম্ভব নয়। রবোটটির এই নির্বোধ অথচ নিষ্ঠুর উত্তর শুনে আমি শিউরে উঠলাম। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, ওকে হাজার যুক্তি দেখিয়েও টলানো যাবে না। এইসব রবোট বহু পুরানো আমলের। মানুষের শরীর যে রবোটের মতো যান্ত্রিক নয়, স্বাভাবিক অবস্থায় অতি অল্প তারতম্যেই যে মানুষ মারা যেতে পারে এবং মানুষের মৃত্যু যে মোটেই আর্থিক ক্ষতি নয়—একটা মারাত্মক মানবিক বিপর্যয়, এই ধারণা এইসব রবোটের কপোট্রনে দেয়া হয় নি। এই রবোটটি নির্বিকারভাবে আমাকে এখানে আটকে রাখবে এবং আমার মৃত্যু তার কপোট্রনের চৌম্বকক্ষেত্রে এতটুকু আলোড়নের সৃষ্টি করবে না।
আমি আবার কথা বলতে গিয়ে অনুভব করলাম, আমার গলা শুকিয়ে গেছে। শুকনো গলাতেই বললাম, তুমি আমাকে বের হতে না দিলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে
কী ক্ষতি?
আমি মারা যাব।
মানে?
তোমার কপোট্রনটি ভেঙে ফেললে তোমার যে-অবস্থা হয়, আমার সেই অবস্থা হবে।
তাহলে খুব বেশি টাকা ক্ষতি হবে না। কিন্তু আপনাকে বের করতে হলে বিভাট্রনটি বন্ধ করতে হবে, ছটা ট্রান্সফর্মার থামিয়ে দিতে হবে, সবগুলি ফিল্ম এক্সপোজাড্ হয়ে যাবে, অর্থাৎ সব মিলিয়ে ছয় হাজার নব্বই টাকা নষ্ট হয়ে যাবে। সেই তুলনায় আপনার মূল্য মাত্র চার শ আশি টাকা।
চার শ আশি টাকা?
হ্যাঁ। মানুষের শরীর যেসব বায়োকেমিক্যাল কম্পাউন্ড দিয়ে তৈরী, খোলা বাজারে তার সর্বোচ্চ মূল্য চার শ আশি টাকা।
অসহ্য ক্ৰোধে আমি দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলাম। এই নির্বোধ রবোটটিকে আমি কীভাবে বোঝাব যে চার শ আশি টাকা বাঁচানোর জন্যে নয়, আমাকে বাঁচানোর জন্যই আমার এখান থেকে বের হওয়া দরকার। একটা মানুষের মূল্য শুধুমাত্র পার্থিব মূল্য নয়, তার থেকেও বেশি কিন্তু তাকে সেটা কে বোঝাবে? অল্প কিছু কীরিগরি জ্ঞান আর তৃতীয় শ্রেণীর যুক্তিতর্ক ছাড়া এটি আর কিছু বোঝে না। তবু আমি আশা ছাড়লাম না। রবোটটিকে ডাক দিলাম, এই, শোন।