তুমি এসব শিখলে কোথায়?
আপনি যাওয়ার পর পড়াশোনা করেছি।
সাহিত্যাটাহিত্য ছেড়ে এসব ধরলে কেন?
প্রমিথিউস উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে থাকল। আমি তার সমস্যার সমাধান খুঁজে দিলাম। মনে মনে একটু খুশিও হলাম। একটু শিখিয়ে—পড়িয়ে নিলে আমাকে সাহায্য করতে পারবে।
এবার আমি পড়াশোনায় অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বুলার জন্যে সময় করে ঘুমোতে হত; খেতে হত; বাকি সময়টা আমি লাইব্রেরি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে কাটোতাম। সময় কেটে যেতে লাগল দ্রুত।
কয়দিন পর বুলা খাবার টেবিলে আমাকে বলল, তোমার প্রমিথিউসকে বিক্রি করে দাও।
কেন? আমি অবাক হলাম।
সে এ নিয়ে আমাকে তিনটি প্রেমপত্র লিখেছে।
শুনে হাসতে গিয়ে আমি বিষম খেলাম। আজকাল প্রমিথিউস নিশ্চয়ই খুব রোমান্টিক উপন্যাস পড়ছে। প্রেমপত্রগুলি দেখলাম, চমৎকার হাতের লেখা, ভারি সুন্দর চিঠি। প্রমিথিউসের লেখা না জানলে আমার ঈর্ষান্বিত হবার কারণ ছিল। আমি জানি প্রমিথিউস কোনোদিন কোনো মেয়েকে ভালবাসতে পারবে না, বড়জোর ওর ভালো লাগতে পারে। যাই হোক, ব্যাপারটা আমি ভুললাম না।
কয়দিন পর বুলা আবার আমায় অভিযোগ করল, প্রমিথিউস ওকে গোলাপ ফুলের তোড়া উপহার দিয়েছে, ওর হাত ধরে অনেকক্ষণ ভালবাসার কথা বলেছে। আমি খানিকটা অবাক হলাম। ওর ভিতরের সব যান্ত্রিক রহস্য আমার জানা। ও কেন যে ভালবাসার অভিনয় করে যাচ্ছে বুঝতে পারলাম না।
সে সপ্তাহে একটি নতুন পরীক্ষা চালান হয়েছিল। ফলাফল ভীষণ দুর্বোধ্য, খানিকটা রহস্যময়। আমি সেগুলি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলাম। রাত অনেক হয়ে গিয়েছে। আমাকে শোয়াতে না পেরে বুলা একাই শুতে গিয়েছে। ব্যাপারটা এত জটিল ও রহস্যময় যে আমার সময়ের অনুভূতি ছিল না। হঠাৎ দরজা খুলে বুলা ছুটতে ছুটতে এসে ঘরে ঢুকল। আতঙ্কে নীল হয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরে বিকারগ্রস্তের মতো বলতে লাগল, প্রমিথিউস-প্রমিথিউস—।
কী হয়েছে? প্রমিথিউস কী হয়েছে?
আমায় মেরে ফেলতে চাইছে।
সে কী। আমি ভীষণ অবাক হলাম। প্রমিথিউসের খুঁটিনাটি, যান্ত্রিক জটিলতা, ভাবনা-চিন্তার পরিধি-সবই আমার জানা। প্রমিথিউস কখনও অন্যায় করতে পারবে না। বুলাকে প্রশ্ন করে বুঝতে পারলাম, প্রমিথিউস ওকে মেরে ফেলতে চাইছিল না, মানুষ যেমন করে একটি মেয়েমানুষকে আদর করে তেমনিভাবে আদর করতে চাইছিল। আমার একটু খটকা লাগল। বুলার প্রতি ওর মোহ জেগেছে অনেক দিন, সুন্দর কিছুর প্রতি আকর্ষণের জন্যে। কিন্তু ইদানীং ও যা করছে তা শুধু মানুষই করতে পারে, ওর মতো জৈব-চেতনাহীন যন্ত্ৰদানবের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। বুলার হাত ধরে আমি প্রমিথিউসকে খুঁজতে গেলাম। প্রমিথিউসের ঘরে বাতি নেভানো। ভিতরে ঢুকেই সুইচ টিপতেই প্রমিথিউস চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল। ওর হাতে কলেজজীবনে কেনা আমার কোল্ট রিভলবারটি।
প্রমিথিউস। আমি আশ্চর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম।
বলুন। সে খুব ঠাণ্ডা গলায় উত্তর করল।
আমি একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করতে চাইলাম, কিন্তু একটা প্রশ্নও করতে পারলাম না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল ও আমাকে গুলি করে বসবে, কিন্তু আমি জানি ও সেটা করতে পারে না।
তোমার হাতে রিভলবার কেন? আমি ওকে প্রশ্ন করলাম।
প্রমিথিউস এমন ভাব করল যে সে আমার কথা শুনতে পায় নি। আপন মনে বলল, আপনি কী জন্য এসেছেন। আমি জানি। কিন্তু সত্যিই বুলাকে আমি ভালবাসি।
এত সব ঘটনার পর প্রমিথিউসের মুখে এই উত্তর শুনে হঠাৎ করে রাগে আমার পিত্ত জ্বলে গেল। আমি ধমকে উঠলাম, ইডিয়ট কোথাকার! ভালবাসার তুমি কী বোবা?
আপনি ভুল করেছেন, স্যার। প্রমিথিউস এতটুকু উত্তেজিত হল না। বলল, আপনারা যখন এখানে ছিলেন না, তখন আমি কপোট্রন নিয়ে পড়াশোনা করেছি। আমি আমার নিজের কপোট্রনে নিজে অপারেশান করেছি। আমি এখন মানুষের মতোই যৌন-চেতনাসম্পন্ন।
আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বুলা আমার হাত ধরে শিউরে উঠল।
কিন্তু স্যার, আপনি ঠিকই বলেছিলেন। প্রমিথিউস দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা শব্দ করল। আমি ভুল করেছি, আমি অন্যায় করেছি। এখন আমি ভালবাসা কি, বুঝতে পারছি। একটা মেয়েকে কেন একটা ছেলে ভালবাসে, আমি অনুভব করতে পারি। প্রমিথিউস রিভলবারটি হাত বদল করল, ম্যাগাজিনটা লক্ষ্য করল তারপর বলল, আমি বুলাকে ভালবেসেছি, কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি। আমাকে কেউ কোনাে দিন ভালবাসবে না। যত অনুভূতিই থাকুক, আমি কদাকার একটা যন্ত্র।
প্রমিথিউসের শেষ কথা কয়টি আর্তনাদের মতো শোনাল। আমি কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বললাম, তা তোমার হাতে রিভলবার কেন? দিয়ে দাও।
প্রমিথিউস আমার কথা না শোনার ভান করল। বলল, আমি বুঝতে পারছি— আমার বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। এরকম শূন্য জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে কী হবে? আমার কী মূল্য আছে? একটা তুচ্ছ যন্ত্র, কতকগুলো নিস্ফল অনুভূতি। প্রমিথিউস সবুজ চোখে বুলার দিকে তাকিয়ে রইল।
বুলা তোমার কাছে আমার আত্মাহুতির কোনো মূল্য নেই। তবু তুমি মনে রেখো একটা যন্ত্র তোমায় ভালবেসে আত্মহত্যা করেছে। প্রমিথিউস রিভলবারটি তার ডান চোখের সামনে ধরল। ঠিক এই জায়গা দিয়ে গুলি করলেই কপেটনের সেলবক্সের কন্ট্রোল টিউবটি গুঁড়ো হয়ে যাবে।
প্রমিথিউস-আমি বাধা দিতে চাইলাম।
স্যার! আপনার দেয়া অনুভূতিই আমার মরে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। রবোটের আত্মা মরে গেলে কী হয়, বলতে পারেন স্যার?