এই যে বুলা! আমি এই শুষ্ক কথা কয়টি দিয়ে অভ্যর্থনা করলেও কিছুক্ষণের ভিতরেই প্রকৃত বক্তব্যে চলে এলাম। বললাম, তুমি আমার কাছে না এলে আমিই তোমার কাছে যেতাম। অর্থাৎ আমি তোমাকে—আমাকে একটু কাশতেই হল, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
বুলা প্রথমে বিক্ষিত হল, পরে লাল হয়ে মাথা নিচু করল। আমি একটু দ্বিধা করে বললাম, তোমার আপত্তি থাকলে জানাতে পার। আমি তো আর এমন কোনো মহৎ ব্যক্তি নই, তুমি তো জানই আমার অনেক দোষ-ত্রুটি।
বুলা সহজ হল খুব তাড়াতাড়ি। স্যার বলে সম্বোধন ও আপনি সম্পর্ক থেকে আমার ছোট্ট, প্রায় অজানা ডাকনামটি দিয়ে সম্বোধন করে তুমি সম্পর্ক এত সহজ করে নিল, যে, আমি অবাক হয়ে গেলাম। আরো অবাক হলাম যখন বুলা জানাল তার কুমারীজীবনের স্বপ্নই হচ্ছে আমার এই ছোট্ট ডাকনামটি দিয়ে আমাকে তুমি বলে ডাকবে।
বুলা বিদায় নেবার পর আমার কোনো কাজেই মন বসল না। আমি প্রমিথিউসকে ডেকে পাঠালাম। প্রমিথিউস দু হাতে কিছু বই নিয়ে হাজির হল। কিছু হ্যাভলক এলিসের লেখা, কিছু ফ্রয়েডের লেখা।
আপনি বলেছিলেন, প্রমিথিউস একটু ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, খুব বেশি ভালো লাগার নাম ভালবাসা। কিন্তু এখানে অন্য কথা লিখেছে। প্রমিথিউস হ্যাভলক এলিসের একটা বই আমার হাতে তুলে দিল। বলল, এখানে লিখেছে ছেলে ও মেয়ের ভিতরে জৈবিক কারণে যে আকর্ষণ হয়, তার নাম ভালবাসা।
আমি একটু মুশকিলে পড়ে গেলাম। প্রমিথিউসকে তৈরি করার সময় এসব সমস্যা মোটেও ভেবে দেখি নি। আমি বললাম, তোমায় ওভাবে বলেছিলাম, কারণ তুমি এ ছাড়া বুঝবে না। তুমি পৃথিবীর যে-কোনো রবোট থেকে উন্নত, তোমার সুভূতি আছে; কিন্তু তবুও তুমি সম্পূৰ্ণ নও। জীবজগতের একটা মূল অনুভূতি—যৌনচেতনা তোমার নেই।
কেন? প্রমিথিউস দুঃখ পেল। আপনি আমাকে ভালো লাগার, দুঃখ পাবার অনুভূতি দিয়েছেন, তবে এটি দিলেন না কেন?
আমি অল্প উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। বললাম, কারণ আছে প্রমিথিউস। প্রাণীদের এ চেতনা আছে, কারণ বংশবৃদ্ধিতে এটা তাদের দরকার। কিন্তু তুমি এটা দিয়ে কী করবে? তুমি কখনোই একটা শিশু রবোট জন্ম দেয়ার জন্যে একটা মেয়ে রবোট পাবে না।
প্রমিথিউস চুপ করে থাকল। বইগুলি টেবিলে রেখে বলল, আপনি আমাকে এই অসম্পূৰ্ণ অনুভূতি না দিলেও পারতেন। ছেলে আর মেয়েরা এমন কতকগুলি আচরণ করে, তা আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়। এতদিনে বুঝতে পারলাম ছেলে আর মেয়ের ভালবাসা কী জিনিস, সেটা অনুভব করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি ভালোলাগা বুঝতে পারব, ভালবাসা বুঝতে পারব না।
প্রমিথিউসের জন্যে আমার মায়া হল। আট ফুট উঁচু যন্ত্রদানব সবুজ চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ অনুনয়ের স্বরে বলল, স্যার, আপনি আমায় যৌনচেতনা দিতে পারেন না? দিন না, মাত্র একটি দিনের জন্যে দিন। আমি দেখি ভালবাসা কি !
আমি রাজি হলাম না। প্রমিথিউস মাথা নিচু করে চলে গেল।
আমার আর বুলার বিয়ে হল নভেম্বরে। বিয়ের পরদিনই আমরা হানিমুনে বের হয়ে গেলাম। বাসার যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণের ভার থাকল প্রমিথিউসের উপর। দৈব দুর্ঘটনায় বৈদ্যুতিক গোলযোগ ঘটে প্রমিথিউসকে যেন অচল হয়ে থাকতে না হয়, সেজন্যে তার ভিতরে একটা ছোট পারমাণবিক ব্যাটারি সংযোজন করে গেলাম।
আমি আর বুলা ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়ালাম। কখনো পাহাড়ে, কখনো বনে, কখনো—বা সমুদ্রের বালুবেলায়। আমাদের মধু-চন্দ্ৰিমার দিনগুলি কেটে যেতে লাগল দ্রুত। বাসায় ফিরে যাবার তাগিদ কিছুতেই অনুভব করছিলাম না। মাঝে একদিন ফোনে প্রমিথিউসের সাথে কথা বলেছি। সে জানিয়েছে সব ভালোই চলছে।
কিছুদিন পর আমার হঠাৎ করে কোয়ার্কের সাব-স্ট্রাকচার নিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছে করতে লাগল। চৰ্বিশ ঘন্টার ভিতর আমার ইচ্ছাটা এমন অদম্য হয়ে উঠল যে, আমি প্রমিথিউসের কাছে একটা টেলিগ্রাম করে দিলাম ষ্টেশনে গাড়ি পাঠাবার জন্যে। বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে যে-চাকরিটি দিতে চাইছিল সেটা এখনো দিতে রাজি কি না জানতে চেয়ে আরেকটা টেলিগ্রাম করলাম। জাতীয় পুস্তকালয়ে দু। ডজন। বইয়ের জন্যে লিখে পাঠালাম। আমার আচরণে বুলা অবাক হল না, বরং ভারি খুশি হয়ে উঠল। গবেষণামূলক কোনো কাজে সত্যিকার আগ্রহ নিয়ে লেগে থাকা কোনো মেয়ে পছন্দ না করে পারে না। এতে স্বস্তি আছে, ছকে ফেলা নিশ্চিত জীবন, এমন কি খ্যাতির বাঁধা সড়কের ইঙ্গিতও আছে।
আমরা পরদিন বাসায় পৌঁছে গেলাম। বাসার সব ভার বুলার উপর দিয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকের দায়িত্বটি নিয়ে নিলাম। একটু গুছিয়ে নিতে আমার মূল্যবান ছটা দিন নষ্ট হয়ে গেল। আমি আবার পড়াশোনা ও গবেষণার কাজ শুরু করে দিলাম। একদিন রাত্রিকালে হঠাৎ নিঃশব্দে প্রমিথিউস এসে দাঁড়াল। পড়াশোনার সময় কেউ আমাকে বিরক্ত করলে আমি সহ্য করতে পারি না। ভুরু কুঁচকে বললাম, কি চাই?
কপোট্রনিক সেলে বিদ্যুৎচৌম্বকীয় আবেশের জন্যে যে রেসিড়ুয়াল ম্যাগনেটিজমের সৃষ্টি হয়, তার ভারসাম্য রক্ষার সমীকরণে জিটা-নটের মান কোথায় পাব?
আমি অবাক হয়ে প্রমিথিউসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তাকে বিজ্ঞানসংক্রান্ত একটি অক্ষরও আমি শেখাই নি। কিন্তু সে যে জিনিসটা জানতে চেয়েছে, তার জন্যে প্রথম শ্রেণীর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যা জানা দরকার।