প্রমিথিউসের এই সংস্কার করতে গিয়ে আমাকে পশুর মতো পরিশ্রম করতে হল। দীর্ঘ সময় প্রমিথিউসকে অচল রেখে তার কপোট্রনে অস্ত্ৰ চালাতে হয়েছে। কপোট্রনের এধরনের জটিল কাজ করে সূক্ষ্ম কাজে পারদশী আর-২১ ধরনের রবোট। দু মােস দশ দিন পর আমি যখন প্রমিথিউসের সংস্কার শেষ করলাম, তখন আমার কন্টাক্ট লেন্সের পাওয়ার বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে, ওজন কমেছে চার পাউন্ড। অবিশ্যি এ-কথা স্বীকার না করলেই নয়, ওজন মাত্র চার পাউন্ড কমার পিছনে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব বুলার। বুলা আমার কাজকর্মে সাহায্য করার নূতন মেয়েটি। প্রমিথিউসের সৌন্দর্যচেতনা সৃষ্টির সময় একজন সাহায্যকারীর জন্যে কোম্পানিকে লিখলে তারা এই মেয়েটিকে পাঠায়। আর দশটা মেয়ের মতো সেও ছুটির সময় চাকরি করে অর্থোপার্জন করছে। সামনের জুলাই মাসে সে পদার্থবিদ্যায় অনার্স পরীক্ষা দেবে।
প্রমিথিউসকে আবার জীবনদান করার সময় ঘরটাকে যথাসম্ভব ফাঁকা করে দিলাম। টিপে আমাকে অপেক্ষা করে থাকতে হল—সূতন আবিষ্কৃত রূডোন মিনিট পাঁচেক পরেই প্রমিথিউসের চোখে বৈদ্যুতিক ফুলিঙ্গ খেলা করতে লাগল। প্রমিথিউস তার একটা হাত অল্প উপরে তুলে দ্বিধান্বিতভাবে আবার নামিয়ে ফেলল।
কেমন আছ? আমার প্রশ্নের উত্তর সে সাথে সাথে দিল না। আগে কখনও এরকম করে নি। একটু পরে বলল, ভালো।
আমার ভুলও হতে পারে, কিন্তু মনে হল ওর কথায় যেন আবেগের ছোঁয়া লেগেছে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, তোমার ভিতরে কোনো পরিবর্তন টের পাচ্ছ?
না তো! কেন?
উত্তর না দিয়ে আমি হাত বাড়িয়ে টেপ রেকর্ডারটি চালিয়ে দিলাম। এহুদি মেনুহিনের বেহালার করুণ সুরে মুহূর্তে সারা ঘর ভরে উঠল। প্রমিথিউস শক্ খাওয়ার মতো চমকে উঠে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি টেপ রেকর্ডারটি বন্ধ করে দিতেই আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, স্যার, বন্ধ করবেন না।
কেন? এটা শুনতে কেমন লাগছে?
প্রমিথিউস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বিড়বিড় করে বলল, এটা বিভিন্ন কম্পনের শব্দতরঙ্গের পারস্পরিক সুষম উপস্থাপন। কিন্তু এটা শুনলে আমার ভিতরে এমন একটা বিচিত্র প্রক্রিয়া হতে থাকে যে, ইচ্ছে হয় আরো শুনি, আরো শুনি।
আমি বুঝতে পারলাম, প্রমিথিউসকে তার নূতন অবস্থার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া প্রয়োজন। বললাম, প্রমিথিউস, এহুদি মেনুহিনের বেহালার সুর শুনে তোমার ভিতরে যে-দুর্বোধ্য শারীরিক প্রক্রিয়া হচ্ছিল, সেটির নাম ভালো লাগা। পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র রবোট, যে ভালো লাগা খারাপ লাগার অনুভূতি বুঝতে পারে।
প্রমিথিউস দুপা সরে এল। যান্ত্ৰিক মুখে একাগ্রতা, নিষ্ঠা ইত্যাদি ছাপ ফোটানোর পরবর্তী পরিকল্পনা আমার মাথায় উঁকি দিয়ে গেল।
আস্তে আস্তে ভূমি আরো নূতন অনুভূতির সাথে পরিচিত হবে।
কি রকম?
যেমন এই গোলাপ ফুলটি। আমি জানালা খুলে তাকে বাগানের সবচেয়ে সুন্দর গোলাপ ফুলটি দেখলাম।
স্যার। প্রমিথিউস চেঁচিয়ে উঠল, আমার ভালো লাগছে!
হ্যাঁ। সুন্দর জিনিস দেখলেই তোমার ভালো লাগবে, তবে তা চেঁচিয়ে বলার দরকার নেই। আমি তাকে ফুলটি ছিঁড়ে আনতে বললাম। সে ফুলটিকে ছিঁড়ে এনে চোখের সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। আমি তার হাত থেকে ফুলটি নিলাম, নিয়ে হঠাৎ কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেললাম!
প্রমিথিউসের ভিতর থেকে আর্তনাদের মতো একটা যান্ত্রিক শব্দ বের হল। আবার আমি বললাম, তোমার এখন আমার প্রতি যে-অনুভূতি হচ্ছে–সেটার নাম রাগ। রাগ বেশি হলে তোমার কপোট্রন তোমার উপর যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে।
প্রমিথিউস কোনো কথা বলল না। স্পষ্টতই ও রাগ হয়েছে।
অর্থহীন কাজ দেখলে রাগ হয়। গোলাপ ফুলটা তোমার ভালো লেগেছে, আমি শুধু ওটা ছিঁড়ে ফেলেছি, তাই তোমার রাগ হয়েছে।
প্রমিথিউস অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল, আমার গোলাপ ফুল খুব ভালো লাগে।
খুব ভালো লাগার আর একটি নাম আছে। সেটা হচ্ছে ভালবাসা।
প্রমিথিউস বিড়বিড় করে বলল, আমি গোলাপ ফুল ভালবাসি।
ঠিক সেই সময় কুলা তার একরাশ কালো চুলকে পিছনে সরিয়ে দরজা খুলে ঘরে এসে ঢুকল। বলল, স্যার, আপনার খাবার সময় হয়েছে।
আসছি।
না, এক্ষুনি চলুন, দেরি হলে জুড়িয়ে যাবে। মেয়েটি ছেলেমানুষ, আমাকে না নিয়ে কিছুতেই যাবে না। আপত্তি করব, তার উপায় নেই। কীভাবে জানি আমি তার অনেকটুকু প্ৰভুত্ব মেনে নিয়েছি।
আমি প্রমিথিউসকে বসিয়ে রেখে মেয়েটির পিছে পিছে খাবার ঘরে গেলাম। যাওয়ার সময় শুনলাম প্রমিথিউস বিড়বিড় করে বলছে, আমি এই মেয়েটিকে ভালবাসি।
প্রমিথিউস কিছুদিনেই একজন বিশুদ্ধ সংস্কৃতিবান রবোটে পরিণত হল। তাঁর প্রিয় কবি জাঁ ককতো। মূল ফরাসি ভাষা থেকে প্রমিথিউসের অনুবাদ করা কবিতাগুলি ধারাবাহিকভাবে একটি সাহিত্য পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। আমি তাকে মৌলিক রচনা করার উৎসাহ দিয়েছি। বর্তমানে সে কপোট্রনিক সংশয়গুচ্ছ নাম দিয়ে একটি কবিতার বই লিখিছে।
কিছুদিনের ভিতরে সে উপন্যাস পড়ায় ঝুঁকল। আমি তাকে গোর্কি শেষ করে কাফকায় ড়ুবে যেতে দেখলাম। হেমিংওয়ে, সাত্রে, কামু পড়ে যেতে লাগল দ্রুত।
বুলা পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। প্রমিথিউস আজকাল বুলার দায়িত্ব পালন করছে। স্পষ্টতই প্রমিথিউস খাবার টেবিলে বুলার মতোই আরেকটু মাংস নিতে পীড়াপীড়ি করে, কিন্তু তবুও বুলার অভাবটা আমার সহজে পূরণ হতে চাইল না। মেয়েটি সুন্দরী ছিল, বুদ্ধিমতী ছিল এবং আমার জন্যে প্রকৃত অর্থে মমতাও ছিল। বুলা চলে যাওয়ার পরপরই আমি বুঝতে পারলাম, আমি বুলাকে ভালবেসেছিলাম। আমার নিজস্ব ধ্যান-ধারণার মানবিক এই সমস্ত উচ্ছাসগুলির বিশেষ কোনো মূল্য নেই। কিন্তু যতই বুলার কথা ভূলতে চাইলাম, তত মস্তিষ্কের কোথাও অসম বৈদ্যুতিক আবেশ হতে থাকল। কাজেই যেদিন বুলা প্রমিথিউসের তত্ত্বাবধানে আমার জীবনযাত্রা কেমন চলছে দেখতে এল, সেদিন আমার আন্নদের সীমা রইল না।