সমুদ্রের তীরে রবোটরা বিষণ্ণভাবে বসে থাকতে লাগল। বালুর উপর মুখ গুঁজে কেউ কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
শুরা ইলেনের প্রহরা দিতে ভুলে গেল, কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেল। ল্যাবরেটরির কোনায় কোনায় মাকড়সারা জাল বুনতে লাগল। ঘর ভেঙে একদিন ইলেন বেরিয়ে এল দেখেও কেউ কিছু বলল না। কপোট্রনে গুলি করে দ্বীপের মাঝখানে প্রকাশ্যে একটি রবোট আত্মহত্যা করল। হতাশা, হতাশা আর হতাশা—পুরো দ্বীপটিা তীব্র হতাশায় ড়ুবে গেল। তাদের ভিতরে ইলেন ক্ষ্যাপার মত ঘুরে বেড়াতে থাকে, রবোটদের উৎসাহউদ্দীপনা দিয়ে চাঙ্গা করে তুলতে চেষ্টা করতে থাকে। তারপর একদিন সেও বালুর উপর মাথা কুটে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদতে লাগল। অপরাধীরা দুঃখ পেলে সে-দুঃখ বড় ভয়ানক হয়ে দাঁড়ায়। কয়েকটি রবোট মায়াবশত ওর কপোট্রনের উপর অস্ত্ৰ চালিয়ে কনশেন্সের কানেকশান ঠিক করে দিল। ওদের আর অপরাধী রবোটের প্রয়োজন নেই। টেলিভিশন ক্যামেরা দিয়ে পাঠানো ছবিতে আমরা একটি জাতিকে হতাশায় ড়ুবে যেতে দেখলাম।
এক মাসের ভিতর পুরো দ্বীপটা মৃতপুরী হয়ে গেল। অন্ধকার জঞ্জালের ভিতর মরচেপড়া বিবৰ্ণ রবোটেরা ঘুরে বেড়ায়, উদ্দেশ্যহীনভাবে শিস দিয়ে গান করে, হু-হু করে কেন্দে ওঠে, তারপর চুপচাপ আকাশের দিকে মুখ করে বালুতে শুয়ে থাকে। মাঝে মাঝেই দুটি–একটি রবোট আত্মহত্যা করে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে। উন্নতির এই চরম শিখরে উঠে ওদের কেন এমন হল, কেউ বলতে পারে না। হাজারো জল্পনা-কল্পনা চলতে লাগল। আমার বড় ইচ্ছে করতে লাগল ওই রবোটদের সাথে—এককালীন সহকমী ইলেনের সাথে কথা বলে দেখি। কিন্তু উপায় নেই, ওই দ্বীপটি সরকার নিষিদ্ধ এলাকা ঘোষণা করেছে।
প্রচণ্ড শব্দ শুনে ঘুম ভাঙতেই আমার মনে হল আশপাশে কোথাও একটা হেলিকপ্টার এসে নামল। আবাসিক এলাকায় হেলিকপ্টার নামানো যে বেআইনি এটা জানে না। এমন লোক এখনও আছে ভেবে আমি বিস্মিত হলাম। আমি বালিশে কান চেপে শুয়ে থাকলাম। শব্দ কমে গেল একটু পরেই। আমি আবার ঘুমোবার জন্যে চোখ বুজলাম, ঠিক তক্ষুণি দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ হল। এত রাতে কে হতে পারে ভাবতে ভাবতে আমি উঠে এলাম। দরজা খুলে দিয়েই আমি ভয়ানক চমকে উঠি। দরজার সামনে ইলেন দাঁড়িয়ে আছে—মরচেপড়া স্থানে স্থানে রং-ওঠা বিবৰ্ণ জ্বলে যাওয়া বিধ্বস্ত একটি রবোট। বাসার বাইরে দূরে কালো কালো ছায়া, ভালো করে লক্ষ করে বুঝলাম সশস্ত্ৰ মিলিটারি, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্ৰ তাক করে আছে।
প্রফেসর। লাউড স্পীকারে একজন সার্জেন্টের গলার স্বর শুনলাম। রবোটটি কোনো ক্ষতি করবে মনে হলে বলুন গুলি করে কপোট্রন উড়িয়ে দিই।
না-না, আমি চেঁচিয়ে উত্তর দিলাম, ইলেন আমার বিশ্বস্ত বন্ধু ও কোনো ক্ষতি করবে না।
ঠিক আছে। সার্জেন্ট উত্তর দিল, আমরা পাহারায় আছি।
ইলেন বিড়বিড় করে বলল, পুরো ছয় শ কিলোমিটার আমার হেলিকপ্টারের পিছনে পিছনে এসেছে। আশ্চর্য! আমাকে এত ভয়? আমি কি কখনো কারো ক্ষতি করতে পারি?
আমি ইলেনকে ডাকলাম, ভিতরে এস ইলেন, অনেক দিন পড়ে দেখা।
ইলেন ভিতরে এসে তার এক বছর আগেকার নির্দিষ্ট জায়গায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল। বলল, ভালো আছেন স্যার?
ভালো। তোমার খবর কি? এমন অবস্থা কেন?
সবই তো জানেন-বলে ইলেন একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করল।
জানি না কিছুই। তোমরা হঠাৎ করে হতাশাগ্ৰস্ত হয়ে পড়েছি, খবরটুকু পেয়েছিমাত্র। কেন এমন হল বুঝতে পারি নি।
সে জন্যই এসেছি স্যার। আমার ভারি অবাক লাগছে। আমরা রোবটেরা মাত্র এক বছরের ভিতর হতাশাগ্ৰস্ত হয়ে গেছি, অথচ আপনারা, মানুষেরা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বেচে আছেন। একবারও হতাশাগ্রস্ত হন নি। এমন কেন হল?
আমি একটা সিগারেট ধরলাম। তোমরা হতাশাগ্ৰস্ত হলে কীভাবে?
আপনি তো জানেন, আমাকে বন্দি করে রেখেছিল। আমি সেলে বসে বসে এই এক বছর ধরে সব কিছু লক্ষ করে গেছি। রবোটেরা যখন বেঁচে থাকার সবরকম প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করল, তখন সবার মনেই একটা প্রশ্ন জেগে উঠল, এখন কী করব? এ কয়দিন সব সময়েই একটা-না-একটা কাজ করতে হত, কিন্তু এখন কী করব? স্বভাবতই মনে হল, এখন আনন্দে বেঁচে থাকার সময় হয়েছে। গবেষণা করে সাহিত্য-শিল্পের চর্চা করে, অর্থাৎ যে যে-বিষয়ে আনন্দ পায় সেটিতে মগ্ন হয়ে সুখে বেঁচে থাকতে হবে।
ইলেন একটু থেমে বলল, সুখে বেঁচে থাকতে গিয়ে ঝামেলা দেখা দিল। সবাই প্রশ্ন করতে লাগল, কেন বেঁচে থাকিব? শুধু শুধু বেঁচে থেকে গবেষণা করে, জ্ঞান বাড়িয়ে শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করে শেষ পর্যন্ত কী হবে? তখন সবার মনে হতে লাগল, এসব অর্থহীন, বেঁচে থাকা অর্থহীন। ভিতরে কোনো তাড়না নেই, চুপচাপ সবাই হতাশায় ড়ুবে গেল। আচ্ছা স্যার, আপনাদের কখনো এরকম হয় নি?
আমি মাথা ঝাঁকালাম, বিচ্ছিন্নভাবে দু-একজনের হতে পারে, জাতির একসাথে কখনো হয় নি।
ইলেন আবার শুরু করল, আমি সেল ভেঙে বেরিয়ে এসে ওদের ভিতরে অনুপ্রেরণা জাগাবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কোনো লাভ হল না। ক্ষেপে গিয়ে কয়েকটা রবোটকে মেরে ফেলেছিলাম—জানেনই তো, আমি সবরকম অপরাধ করতে পারতাম। কী লাভ হল? ওদের দেখতে দেখতে, ওদের সাথে থাকতে থাকতে আমারও মনে হতে লাগল, বেঁচে থাকা অর্থহীন, কেন বেঁচে থাকিব? তখন এমন কষ্ট হতে লাগল, কী বলব! বালুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম। অন্যেরা আমার কপোট্রন ঠিক করে না দিলে আর অপরাধ করার ইচ্ছে হত না। কিন্তু কী লাভ? যার বেঁচে থাকার ইচ্ছেই নেই, তার অপরাধ করায় না-করায় কী এসে যায়?