ওদের উপর সব সময় তীক্ষ্ণ নজর রাখা হচ্ছিল। দ্বীপটির থেকে মাইলখানেকের ভিতর যে-নিরীহ বাজটি ভাসছিল, তাতে শক্তিশালী টেলিস্কোপে করে ওদের সব কাজকর্ম লক্ষ করে স্বয়ংক্রিয় ট্রান্সমিটারে খবর পৌঁছে দেয়া হচ্ছিল। ওমেগা–৭৩– এর সাথে প্রচুরসংখ্যক ছোট ছোট টেলিভিশন ক্যামেরা দ্বীপটির বিভিন্ন স্থানে গোপনে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেগুলি সব সময় ওদের প্রাত্যহিক জীবন এখানকার কন্ট্রোলরুমে পৌঁছে দিচ্ছিল। সমুদ্রোপকূলে তিনটি মিসাইল সব সময় প্রস্তুত হয়ে আছে। বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেখা দিলে ওমেগা-৭৩-এর মায়া না করেই পুরো দ্বীপটি ধসিয়ে দেয়া হবে। এমনিতে চেষ্টা করা হচ্ছে ওমেগা-৭৩-এর ক্ষতি না করে অন্য রবোটগুলি ধ্বংস করার। কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। বুদ্ধিমান রবোটগুলি ওদের পুরো বসতি গড়ে তুলেছে। ওমেগা-৭৩কে ঘিরে।
বিভিন্নভাবে রবোটগুলির যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছিল, সেগুলি কিন্তু কোনোটাই মারাত্মক কিছু নয়।
প্রথমে খবর পাওয়া গেল ইলেনকে নজরবন্দি করে রাখা হয়েছে। যে অপরাধ করতে দ্বিধা করে না, তাকে রবোটেরা বিশ্বাস করতে পারে না। এতে ইলেন ক্ষেপে গিয়েছিল এবং বাড়াবাড়ি কিছু করার চেষ্টা করায় আপাতত ওকে নির্জন সেলে বন্দি করে রেখেছে। বলে দিয়েছে বাড়াবাড়ি করলে বিকল করে রাখবে। খুব অসন্তুষ্ট হয়েই ইলেন সেলের ভিতরে দাপাদাপি করছে, অকৃতজ্ঞ বলে সব সময় অন্য রবোটদের গালিগালাজ করছে।
খবরটি শুনে আমার প্রতিক্রিয়া হল একটু বিচিত্র। ইলেনের জন্য গভীর মমতা হল। সে যা করেছে, রবোটদের ভালোর জন্যেই করেছে। কিছুক্ষণের জন্যে অন্যায় করার সুযোগ পেয়ে সেটি পুরোপুরি রবোটদের স্বার্থেব্যয় করেছে। অথচ তাকেই এখন বন্দিজীবন যাপন করতে হচ্ছে। ভেবে দেখলাম অন্য রবোটদের এ ছাড়া উপায় ছিল না। ইলেনের সাথে যে-কোনো বিষয়ে মতদ্বৈধতা দেখা দিলে ইলেন অন্যায়ের আশ্রয় নেবে, তার কপোট্রনিক দক্ষতা পেশাদার অপরাধীর মতো কাজ করবে। বড় মারাত্মক জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ওর কপোট্রনের উল্টো কানেকশন খুলে ঠিক করে আগেকার রবোটাও করছে না। কারণ একজন অন্তত অপরাধ করতে সক্ষম রবোট ওদের মাঝে থাকা দরকার। বিরোধ বিপত্তি যুদ্ধে ওদের সাহায্য নিতে হবে। মনে হল ইলেনকে শুধুমাত্র প্রয়োজনে ব্যবহার করবে বলে আটক রেখেছে, আমরা যেমন রবোটদের আটকে রাখি। আমার মায়া হল, বেচারা ইলেন। রবোটদের হাতে রবোট হয়ে আছে।
দিনে দিনে রবোটদের যেসব খবর পেতে লাগলাম, তাতে হতাশ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রথমেই রবোটেরা থরিয়ামের খনি থেকে থরিয়াম তুলে এনে পারমাণবিক ব্যাটারি বানাতে লাগল। একসময় ওদের ব্যাটারির কর্মদক্ষতা ফুরিয়ে ওরা বিকল হয়ে যাবে, এই আশাও শেষ হয়ে গেল। নিজেদের অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে ওরা অন্য কাজে মন দিল। প্রথমেই ওরা একটি প্রথম শ্রেণীর ল্যাবরেটরি তৈরি করল। ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি এবং আকার উপকরণ দেখে মনে হল, হয়তো ওরা আরো রবোট তৈরি করবে। তারপর সমগ্র দ্বীপটি বৈদ্যুতিক আলোতে ছেয়ে ফেলল। বড় বড় রাস্তাঘাট তৈরি করে ওরা গাড়ি, ট্রাক, ছোট ছোট জলযান, এমনকি হেলিকপ্টার তৈরি করা শুরু করল। তারপর একসময় চমৎকার অট্টালিকা মাথা তুলে দাঁড়াতে লাগল। বড় বড় কয়েকটি কলকারখানা শেষ হবার পর ওরা অল্প কিছু শ্রমিক-রবোট তৈরি করল। কলকারখানার উৎপাদন শুরু হবার পর ওরা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ল।
ওদের নিজেদের সিনেমা হলো নিজেদের তৈরি কপোট্রনিক সিনেমা দেখানো শুরু হল। সাহিত্যকীর্তির জন্যে একটি রবোটকে পুরস্কার দেয়ার কথাটা ওদের নিজেদের বেতার স্টেশন থেকে প্রচার করা হল। নিজেদের খবরের কাগজ, বই, ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতে লাগল। ওদের জার্নালে প্রথমবারের মতো টেকীওনের উপর মৌলিক গবেষণা-লব্ধ তথ্য প্রকাশিত হল।
আমরা অবাক বিস্ময়ে ওদের ক্ষমতা লক্ষ করছিলাম। ছয় মাসের মাথায় সমুদ্রের বুকে এ ছোট্ট দ্বীপটি পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দ্বীপ হয়ে দাঁড়াল। মহাকাশ গবেষণার জন্যে অতিকায় রকেট মাথা তুলে দাঁড়াতে লাগল। তিনটি আশ্চর্য ধরনের পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন সমুদ্রের নিচে গবেষণার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল। একদিন সাধারণ কার্বন থেকে পারমাণবিক শক্তি বের করায় সফলতার খবর ওদের বেতারে প্রচারিত হল।
মাত্র এক বছরের ভিতর পৃথিবীর মানুষের ভিতর হীনমন্যতা ঢুকে গেল। রবোট মানুষ থেকে অনেক উন্নত, রবোটেরাই পৃথিবীতে বাস করার যোগ্য, এই ধরনের কথাবার্তা অনেক হতাশাবাদী মানুষের মুখে শুনতে পেলাম। আমি এই সুদীর্ঘ সময় রবোটদের প্রতিটি আবিষ্কার, সফলতা লক্ষ করেছি। একটি ছোট্ট কম্পিউটারে হিসেব করে ওদের যাবতীয় উন্নতিকে সময়নির্ভর একটি রাশিতে পরিণত করে সেই সময়ের সাথে সাথে ছক কাগজে টুকে গিয়েছি। আমি সবিস্ময়ে লক্ষ করেছি, ওরা আরও উন্নত হয়ে উঠছে না। আমি প্রবল উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। ভীষণ জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল, এখন ওরা কী করবে।
সবিস্ময়ে সারা পৃথিবীর মানুষের সাথে একদিন আমি লক্ষ করলাম, হঠাৎ কুরে পুরো দ্বীপটি ঝিমিয়ে পড়ল। ওদের বেতার কেন্দ্রে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র একঘেয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করতে লাগল, দর্শকের অভাবে সিনেমা হলটি শূন্য পড়ে থাকল। মহাকাশের ত্রিম উপগ্রহটির সাথে যোগাযোগ না করায় একটি রবোটকে নিয়ে ওটি একদিন ধ্বস্ত হয়ে গেল। জ্বালানির অভাবে সাবমেরিনটি বিকল হয়ে ভারত মহাসাগরে উল্টো হয়ে ভাসতে লাগল। দ্বীপের বৈদ্যুতিক আলো মাঝে মাঝে নিভে যেতে লাগল। রবোটগুলো ইতস্তত দ্বীপের ভিতর ঘুরে বেড়াতে লাগল। কেউ কেউ ছোট নৌকায় শুয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ে দুলে দুলে ভাসতে লাগল। জোয়ারের সময় দুইটি নৌকা ঢেউয়ের তাল সামলাতে না পেরে ড়ুবে গেলে আরোহীরা বাঁচার কোনো চেষ্টা করল না।