মানে? আমার সবকিছু গুলিয়ে গেল। আপনার কথা সত্যি হলে আমার আরো অস্তিত্ব আছে?
শুধু আপনার নয়, প্রত্যেকের, প্রত্যেকটি জিনিসের অসীমসংখ্যক অস্তিত্ব। আপনারা আমরা সবাই সময়ের সাথে সাথে এক অস্তিত্ব থেকে অন্য অস্তিত্বে প্রবাহিত হই। যে—অস্তিত্বে আমরা প্রবাহিত হই সেটিকেই সত্য বলে জানি—তার মানে এই নয় অন্যগুলি কাল্পনিক।
তা হলে ব্যাপারটি দাঁড়াচ্ছে এরকম। আমি একটু চিন্তা করে নিলাম। পৃথিবী সৃষ্টি হল, মানুষের জন্ম হল, সভ্যতা গড়ে উঠল, একসময় আমার জন্ম হল। আমি বড় হলাম, একসময়ে মারা গেলাম। তারপর অনেক হাজার বছর পার হল, তখন আপনি সৃষ্টি হলেন। আপনি অতীতে ফিরে এলেন আবার আমার কাছে। আবার আমি বড় হব, মারা যাব, কিন্তু সেটি আগের আমি না-সেটি আমার আগের জীবন না, কারণ আগের জীবনে আপনাকে আমি দেখি নি।
ঠিক বলেছেন। এইটি নতুন অস্তিত্বে প্রবাহ। আপনার পাশাপাশি আরো অনেক জীবন এভাবে বয়ে যাচ্ছে, সেগুলি আপনি দেখবেন না, বুঝবেন না—
কেন দেখব না?
দুই সমতলে দুটি সরল রেখার কোনোদিন দেখা হয় না, আর এটি তো ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্বের প্রশ্ন।
আমি মাথার চুল খামচে ধরলাম। কী ভয়ানক কথা! এই পৃথিবী, জীবনপ্রবাহ, সভ্যতাকে কী সহজ ভাবতাম। অথচ এর নাকি হাজার হাজার রূপ আছে, সবাই নিজেদের সত্যি বলে ভাবছে। আমি কাতর গলায় বললাম, এইসব হাজার হাজার অস্তিত্ব ঝামেলা করে না? একটা আরেকটার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে—
হতে পারে। আমরা মাথা ঘামাই না। আমরা আমাদের জীবনপ্রবাহটিকে ঠিক রাখতে চাই। এ-ব্যাপারে অন্য কোনো অস্তিত্ব ঝামেলা করলে আমরা তাদের জীবনপ্রবাহ বদলে অন্যরকম করে ফেলি, এর বেশি কিছু না।
বুঝতে পারলাম না।
যেমন ধরুন আপনাদের জীবনপ্রবাহটি, এটির ভবিষ্যৎ খুব সুবিধের নয়। আমরা যেরকম খুব সহজে মানুষকে পরাজিত করে জ্ঞানবিজ্ঞানের সাধনা, পৃথিবীর কতৃত্ব আমাদের হাতে নিয়ে নিয়েছি, আপনাদের ভবিষ্যতে রবোটরা তা পারত না, আমি যদি এখানে না। আসতাম। আপনাদের ভবিষ্যতের মানুষদের আমাদের অস্তিত্বে হামলা করে মানুষের পক্ষ থেকে রবোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কথা। আমরা সেটি চাই না, তাই এটা পরিবর্তিত করতে চাইছি।
কীভাবে?
এই যে আপনার কাছে চলে এলাম-এতে এই অতীতটি পরিবর্তিত হয়ে নুতন দিকে চলছে। আমরা দেখে এসেছি, এখন খুব তাড়াতাড়ি রবোটরা আপনাদের পরাজিত করে ক্ষমতা নিয়ে নেবে। জ্ঞানবিজ্ঞান সাধনায় আর কোনো অন্তরায় থাকবে না।
আমি চুপ করে রইলাম।
তারপর ধরুন জীবনসৃষ্টির ব্যাপারটা। আমার অতীতে যাওয়ার প্রথম কারণই তো এইটি।
কি-রকম?
আমাদের প্রত্নতত্ত্ববিদরা পৃথিবীর এক আদিম গুহায় কয়েক শত কোটি বছর আপুকুর একটি আশ্চর্য জিনিস পেয়েছিলেন
আমাকে পেয়েছিলেন। এই টাইম মেশিনে বসে আছি, অবশ্যি বিধ্বস্ত অবস্থায়।
মানে?
হ্যাঁ, আমার কপোট্রন বিশ্লেষণ করে দেখা গেল। আমি কতকগুলি এককোষী প্রাণী নিয়ে গিয়েছিলাম।
কেন?
পৃথিবীতে প্ৰাণ সৃষ্টি করতে। পৃথিবী সৃষ্টির পরে এখানে প্রাণের জন্ম সম্বন্ধে আপনারা যা ভাবছেন, তা সত্যি নয়। মহাকাশ থেকে জটিল জৈবিক অণু থেকে নয়, মাটি পানির ক্রমাগত ঘর্ষণে স্বাভাবিক উপায়ে নয়, ঈশ্বরের কৃপাতেও নয়, আমিই অতীত প্ৰাণ নিয়ে গিয়েছি। শুদ্ধ করে বললে বলতে হয়, প্ৰাণ নিয়ে যাচ্ছি।
মানে? আপনি বলতে চান সুদূর অতীতে এই এককোষী প্রাণী ছড়িয়ে দিলে পরেই প্রাণের জন্ম হবে, ক্রমবিবর্তনে গাছপালা, ডাইনোসর, বাঘ-ভালুক, মানুষ এসবের জন্ম হবে না?
ঠিক ধরেছেন।
কিন্তু যদি আপনি ব্যর্থ হন? আমি কঠোর গলায় বললাম, যদি আপনি অতীতে এককোষী প্ৰাণী নিয়ে প্রাণের সৃষ্টি করতে না পারেন তাহলে কি এই জীবন, সভ্যতা কিছুই সৃষ্টি হবে না?
ব্যৰ্থ হওয়া সম্ভব নয়, যেহেতু আমাকে কয়েক শত কোটি বছর আগে পাওয়া গেছে, কাজেই আমি ব্যর্থ হলেও আমার অন্য কোনো অস্তিত্ব নিশ্চয়ই অতীতে প্ৰাণ রেখে আসবে। তবে তার প্রয়োজন হবে না। আমার ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা নেই। আমি পুরো অতীত পর্যবেক্ষণ করে দেখছি।
কিন্তু তবু যদি আপনি ব্যর্থ হন?
বললাম তো হব না। আমি আমার পুরো যাত্রাপথ ছকে এসেছি।
কিন্তু যদি তবুও কোনোভাবে ব্যর্থ হন? আমি একগুয়ের মতো বললাম, কোনো দুৰ্ঘটনায় যদি আপনার মৃত্যু হয়? কিংবা আপনার টাইম মেশিন যদি ধ্বংস হয়?
তা হলে বুঝতে হবে আমি অন্য এক জগতে ভুলে নেমে পড়েছি।
সেটির ভবিষ্যৎ কি?
কে বলতে পারে। তবে-রবোটটি মনে মনে কী হিসেবে করল, তারপর বলল, যদি আমি কোনো জগতে নামার দরুন অতীতে ফিরে যেতে ব্যর্থ হই, তবে সেজগতের ভবিষ্যৎ খুব খারাপ, এখনও মানুষ খুঁকঠুক করে জ্ঞানসাধনা করছে। রবোটটি হা-হা করে হাসল, বলল, হয়তো আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে একেবারে গোড়া থেকে সভ্যতা সৃষ্টি করছে। রবোটটি আবার দুলে দুলে হেসে উঠল। মানুষের প্রতি এর অবজ্ঞা প্রায় নিষ্ঠুরতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, কিন্তু সে নিজে এটি বুঝতে পারছে না।
আমি অনেক কষ্ট করে শান্ত থাকলাম। তারপর মৃদুস্বরে বললাম, আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
আরো আলাপ করার ইচ্ছে ছিল, রবোটটি বলল, কিন্তু এই টাইম মেশিনটি একটু পরে নিজে থেকে চালু হয়ে উঠবে। আর সময় নেই।
এক সেকেণ্ড। আমার টোপনের কথা মনে হল। বললাম, আমার ছেলে ভবিষ্যতের অধিবাসী দেখতে ভীষণ আগ্রহী। শুর আগ্রহেই আপনার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে-ওকে একটু ডেকে আনি।