ফার্মগুলোর ক্যাটালগে আমার মনোমতো কপোট্রন পাওয়া গেল না। একটি ফার্ম অবশ্যি ঘোষণা করেছে, হাসতে পারবে এমন একটি কপোট্রন তারা শীঘ্রই প্রদর্শন করবে। তাদের সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম, শীঘ্রই বলতে তারা আরও চার বছর পরে বোঝাচ্ছে। তারা দুঃখ করে লিখেছে, অনুভূতিসম্পন্ন রবোট তৈরির পরিকল্পনা সরকার অনুমোদন করতে চাইছে না, কারণ এটার কোনো ব্যবহারিক গুরুত্ব নেই।
আমি একটি দেশীয় ফার্মকে অর্ডার দিয়ে একটি সাধারণ বি-১ ধরনের কপোট্রন তৈরি করলাম। এটির নিউকেপটিভ সেলের সংখ্যা সাধারণ কপোট্রনের চার গুণ, মানুষের নিউরোন সেলের প্রায় অর্ধেকসংখ্যক। তবে এটির কোনোরকম যান্ত্রিক দক্ষতা নেই। আমাকে কপোট্রনটি হস্তান্তরের সময় ডিরেক্টর ভদ্রলোক এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলে
কপোট্রনটিকে বিভিন্ন অংশের সাথে সংযুক্ত করে রবোটের আকৃতি দিতে আমাকে প্রায় রবোটের মতোই খাটতে হল। পূর্বঅভিজ্ঞতা না থাকায় আমার সময়ও লাগল। অনেক বেশি। সৌভাগ্যক্রমে আমি আমার সব বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি। আমাকে এই ছেলেমানুষি কাজে এরকম সময় নষ্ট করতে দেখলে তাদের বিরক্তির অবধি থাকত না।
রবোটটি শেষ করার পর তার চেহারা দেখে আমার তাক লেগে গেল। রবোট তৈরির প্রথম যুগে যেরকম অতিকায় রবোট তৈরি করা হত, এটা হয়েছে অনেকটা সেরকম। অতিকায় মাথা, ঠিক মানুষের চোখের সাথে সামঞ্জস্য রেখে দুটি সবুজাভ চোখ—যদিও সব রবোটেই একটিমাত্ৰ চোখ থাকে, আমি দুটি না দিয়ে পারি নি। মুখের জায়গায় স্পিকার। নাক ছাড়া খারাপ লাগছিল দেখে একটা কৃত্রিম গ্রিক ধাঁচের নাক স্কু দিয়ে এটে দিয়েছি। চতুষ্কোণ শরীরের দু পাশে ঝুলে থাকা হাত, হাতে মোটা মোটা ধাতব আঙুল। দুটো থামের মতো শক্ত পা, হাঁটুর জায়গায় জটিল যান্ত্রিক জোড়। পায়ের পাতা বিরাট বড়, গোলাকৃতির, অনেক জায়গা জুড়ে আছে ভারসাম্য রক্ষার গেন্যে। আমি রং করে পায়ের আঙুল, বুকের পেশি, ঠোঁট, কান, চোখের ভুরু, চুল—এসব এঁকে দিলাম। বলতে লজ্জা নেই, তাতে রবোটটির চেহারার উন্নতি না হয়ে কাগতাড়ুয়াদের মতো দেখাতে লাগল।
বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়ার পর রবোটটি চোখ পিটপিট করে ঘুরে দাঁড়াল। তার লুকের ভিতর থেকে একটা মৃদু গুঞ্জনধ্বনি ভেসে আসছিল। সবুজাভ চোখে বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ খেলা করতে লাগল। আমি বললাম, তোমার নাম প্রমিথিউস।
কথাটি আমি ভেবে বলি নি, কিন্তু রবোটটি মাথা ঝুঁকিয়ে সেটি মেনে নেবার পর আমার আর কিছু করার ছিল না।
প্রমিথিউসকে আমার দৈনন্দিন কাজের সাথে পরিচিত করে তুলছিলাম। সে সকালে নাস্তা তৈরি করে দিত, ঘর পরিষ্কার করত এবং মাঝে মাঝে কাপড় ইন্ত্রি করে দিত। বলতে দ্বিধা নেই, তার আচার-আচরণ ছিল পুরোপুরি গবেটের মতো। তার সৌন্দর্যবোধের কোনো বালাই ছিল না। ফুলপ্যান্ট ইন্ত্রি করুত্ব আড়াআড়িভাবে। একদিন স্বাধীনভাবে ঘর পরিষ্কার করতে দেয়ায় দেয়ালে টাঙানো দুটো অয়েলপেইনটিং ফেলে দিয়েছিল।
যখন প্রমিথিউসের সাথে যথেষ্টভাবে পরিচিত হয়ে উঠলাম, তখন একদিন তার বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা নিতে বসলাম। সাধারণ জ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রশ্ন করে তাকে জীবনানন্দ দাশ নামক জনৈক প্রাচীন বাঙালি কবির লাইন পড়ে শোনালাম,
এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে—
জানি না সে এইখানে গুয়ে আছে কিনা–
তারপর জিজ্ঞেস করলাম, এই লাইন দুটি সম্পর্কে তোমার কী মত?
চিন্তায় অসঙ্গত কোনো মানুষের উক্তি।
তাকে গঁগার আঁকা একটি পলিনেশিয়ান মেয়ের ছবি দেখালে সে অনেকক্ষণ ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখে বলল, বিকৃত শারীরিক গঠনের একটি মেয়ের ছবিতে দুর্বোধ্য কারণে সব কয়টি রং অনিয়মিতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
গঁগার শিল্পকীর্তির এ-ধরনের মূল্য বিচারে আমার পক্ষে হাসি চেপে রাখা মুশকিল হল। উচ্চৈঃস্বরে হাসতে হাসতে হঠাৎ হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কী করছিলাম?
আপনি হাসছিলেন।
হাসি কি?
এক ধরনের অর্থহীন শারীরিক প্রক্রিয়া।
তুমি হাস তো।
সে আমার হাসিকে অনুকরণ করে যান্ত্রিক শব্দ করল।
প্রমিথিউসকে নিয়ে হতাশ হবার পিছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল। কিন্তু আমি হতাশ হই নি। তার ভিতরে সৌন্দর্যবোধ সৃষ্টি করার জন্যে আমি কিছু নতুন সংস্কার করব ঠিক করলাম। সৌন্দর্য নিয়ে আমাকে প্রচুর পড়াশোনা করতে হল। সৌন্দর্যের গাণিতিক বিশ্লেষণ। আমাকে এ ব্যাপারে বাস্তব সাহায্য করল।
প্রমিথিউসের ভিতর সৌন্দর্যচেতনা জাগাতে হলে তার ভিতরে এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যার জন্যে সে যখনই সুন্দর কিছুর সম্মুখীন হবে, তখনই তার ভালো লগতে শুরু করবে। সোজাসুজি তাকে ভালো লাগার অনুভূতি দেয়া সম্ভব নয়—তার কষ্ট কমিয়ে দেয়ার অনুভূতি দেয়া যেতে পারে। কষ্ট কমানোর আগে তাকে সবসময়ের জন্যে খানিকটা কষ্ট দিয়ে রাখতে হবে। কপোট্রনের নিউকোপটিভ সেলে একটি অসম বৈদ্যুতিক চাপ দিয়ে রাখলে কপোট্রন তার সবরকম যান্ত্রিক ব্যবস্থা দিয়ে চেষ্টা করবে: বৈদ্যুতিক চাপের অসমতাকে দূর করতে। এই অবস্থাটাকে কপোট্রনের কষ্ট বলা যায়। যখনই বৈদ্যুতিক চাপের অসমতাকে কমানো যাবে, তখনই কষ্ট কমে গিয়ে একটা ভালো লাগার পরোক্ষ অনুভূতি সৃষ্টি হবে। কপোট্রনের সেলগুলির সামনে একটা পরিবর্তনশীল বিদ্যুৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্রের সৃষ্টি করে সহজেই এটা করা যায়। কিন্তু প্রকৃত ঝামেলার সৃষ্টি হবে সুন্দর কিছু দেখা, শোনা বা অনুভব করার সাথে সাথে এই বিদ্যুৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাব পরিবর্তন করার মাঝে। এ জন্যে কপোট্রনের সেলগুলিকে অনেকগুলি ভাগে ভাগ করতে হল। বাইরের জগতের যে-কোনো প্রভাব সেগুলোতে আলাদা আলাদাভাবে ছড়িয়ে পড়ত। সৌন্দর্যের গাণিতিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী সেগুলি সুন্দরের আওতাভুক্ত হলেই কপোট্রনের কৃষ্ট কমতে থাকত—ঘুরিয়ে বলা যায়, কপোট্রনের ভালো লাগা শুরু হত। সৌন্দর্যের তীব্রতা অনুযায়ী সে-ভালো লাগাও কম বা বেশি হতে পারে।