তারপর সবদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সুইচ প্যানেলের সামনে বসে পড়লাম, কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে?
রাত দুটো বাজার পরও কিছু হল না। আমি সব রকম প্রস্তুতি শেষ করে বসে আছি। এখন ঐ ভবিষ্যতের যাত্রী নেমে আসতে চাইলেই হয়। এক সময় লক্ষ করলাম, টোপন টুলে বসে সুইচ প্যানেলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। সারা দিনের উত্তেজনা ওকে দুর্বল করে ফেলেছে, নইলে ও এত সহজে ঘুমোবার পাত্র নয়। ওকে জাগিয়ে দিতেই ধড়মড় করে উঠে বলল, এসেছে?
এখনো আসে নি, দেরি হতে পারে। তুই ঘরে গিয়ে ঘুমে। এলেই খবর দেব।
না না—টোপন প্রবল আপত্তি জানাল, আমি এখানেই থাকব।
বেশ, থাক তাহলে। তোর ঘুম পাচ্ছে দেখে বলছিলাম।
একটু পরে ঘুমে বারকয়েক ঢুলে পড়ে টোপন নিজেই বলল, বাবা, খুব বেশি দেরি হবে? তা হলে আমি না হয় একটু শুয়ে আসি, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ওরা আসতেই ভূমি আমাকে খবর দিও।
ঠিক আছে। পুরো কৃতিত্বটাই তো তোর—তোকে খবর না দিয়ে পারি?
টোপন খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে চলে গেল।
বসে সিগারেট খেতে খেতে বোধহয় একটু তন্দ্ৰামতো এসেছিল। প্রচণ্ড শব্দ শুনে লাফিয়ে উঠলাম। হঠাৎ করে, কিছু বোঝার আগে খালি জায়গায় অতিকায় চ্যাপটামতো ধূসর কী-একটা নেমেছে। ঘরে ঢোকার জন্যে ছোট ছোট দরজা, অথচ এটি কীভাবে ভিতরে চলে এসেছে ভেবে ধাঁধা লেগে যাবার কথা। ভীষণ ধুলাঝালি উড়ছে, রনোমিটার কঁ কঁ শব্দ করে বিপদসংকেত দিচ্ছে, আমি তীব্র রেডিয়েশন অনুভব করে ছুটে একপাশে সরে এলাম। একা এতগুলো সুইচ সামলানো কঠিন ব্যাপার। টাইম মেশিনকে স্থির করতে আমার কালো ঘাম ছুটে গেল।
একটু পরে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, জিনিসটা হোভার ক্র্যাফটের মতো দেখতে, অতিকায়। পিছনের দিকটা চৌকোণা হয়ে গেছে। মাথা চ্যাপটা, তাতে দুটো বড় বড় ফুটো-ভিতরে লাল আলো ঘুরছে। টাইম মেশিনটির মাঝামাঝি জায়গায় খানিকটা অংশ কালো রংয়ের, আমার মনে হল এটিই বোধহয় দরজা ঠিক তক্ষুণি খানিকটা গোল অংশ সরে গিয়ে একটা গর্ত বেরিয়ে পড়ল। উত্তেজনায আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল, আমি আমার হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনতে পেলাম, এক্ষুণি ভবিষ্যতের মানুষ নামবে।
আমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে একজন নেমে এল, ভেবেছিলাম স্পেসসুন্টজাতীয় কিছু গায়ে মানুষ, কাছে আসার পর বুঝতে পারলাম। ওটি একটি রবোট। রবোট হেঁটে আমার সামনে এসে দাঁড়াল, তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, আমার হিসেব ভুল না হলে আপনি আমার কথা বুঝতে পারবেন।
হ্যাঁ, পারছি। আমি রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে নিলাম। সুদূর অতীতের অধিবাসী আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে।
সুদূর ভবিষ্যতের অধিবাসীও প্রত্যুত্তরে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। আমি জীবনে প্রথম একটি রবোটকে হাসতে দেখলাম। কিন্তু তার কথাটি আমার কানে খট করে আঘাত করল। সুদূর ভবিষ্যতের অধিবাসী মানে? তাহলে কি ভবিষ্যতে রবোটরাই পৃথিবীর অধিবাসী?
আমাকে অবতরণ করতে সাহায্য করেছেন বলে ধন্যবাদ। রবোটটির চোখ কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল। তবুও যথেষ্ট ধকল গিয়েছে। একটা ফ্লিচিং বার্ড ছিঁড়ে গেছে।
আমি কী করতে পারি? হাত উল্টিয়ে বললাম, এই শতাব্দীতে যান্ত্রিক উৎকর্ষের ভিতরে যতটুকু সম্ভব—
সে তো বটেই, সে তো বটেই। রবোটটি ব্যস্ত হয়ে বলল, আমরা এতটুকুও আশা করিনি।
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রবোটটির গঠননৈপুণ্য, কথা বলার ভঙ্গি, ক্ষণে ক্ষুণে বদলে যাওয়া চোখের দৃষ্টি, মুখের ভাব লক্ষ করছিলাম। যান্ত্রিক উৎকর্ষ কত নিখুঁত হলে এরকম একটি রবোট তৈরি করা সম্ভব, চিন্তা করতে গিয়ে কোনো কুল পেলাম না। একটি মানুষের সাথে এর কোনো পার্থক্য নেই। খুব অস্বস্তির সাথে মনে হল, হয়তো কোনো কোনো দিকে এটি মানুষের থেকেও নিখুঁত। কিন্তু আমি বিস্ময় ইত্যাদি ঝেড়ে ফেলে কাজের কথা সেরে নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। রবোটটিকে বললাম, আপনি ভবিষ্যৎ থেকে এসেছেন। সবকিছুর আগে আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিন।
নিশ্চয়ই। কিন্তু আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। আপনাদের পৃথিবীর হিসেবে এক ঘন্টা পরে এই টাইম মেশিন নিজে থেকে চালু হয়ে উঠে আমাকে নিয়ে আরো অতীতে চলে যাবে।
এক ঘন্টা অনেক সময়, তার তুলনায় আমার প্রশ্ন বেশি নেই। আমি মনে মনে প্রশ্নগুলি গুছিয়ে নিয়ে বললাম, কেউ অতীতে ফিরে এলে অতীত পরিবর্তিত হয়ে যায়। এটি কী করে সম্ভব?
অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন—
যেমন আপনি আজ থেকে কয়েক হাজার বছর পরে সৃষ্টি হবেন, আপনার অতীতের আপনি সেই, কারণ এখনও আপনি সৃষ্টি হন নি। কিন্তু যেই মুহূর্তে আপনি অতীতে আসবেন, তৎক্ষণাৎ আগের অতীতের সাথে পার্থক্য সৃষ্টি হবে—অতীতটা পরিবর্তিত হয়ে যাবে। এটা কী করে সম্ভব?
রবোটটি অসহিষ্ণু মানুষের মতো কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, আপনি এই সহজ জিনিসটা বুঝতে পারছেন না? অতীত ফিরে এলে তো সে অতীত আর আগের থাকে না, নতুন অতীতের সৃষ্টি হয়।
মানে? অতীত কয়টা হতে পারে?
বহু। এখানেই আপনারা ভুল করছেন। শুধু অতীত নয়, জীবনও বহু হতে পারে। আপনি ভাবছেন আপনার জীবনটাই সত্য, কিন্তু আমার অতীতে আপনার যে অস্তিত্ব ছিল, তাতেও আপনার অন্য এক অস্তিত্ব তার জীবনটাকে সত্যি ভেবেছিল। এই মুহূর্তেও আপনার অনেক অস্তিত্ব বিদ্যমান, আপনার চোখে সেগুলো বাস্তব নয়, কারণ আপনি সময়ের সাথে সাথে সেই অস্তিত্ত্বে প্রবাহিত হচ্ছেন না। অথচ তারা ভাবছে তাদের অস্তিত্বটাই বাস্তব, অন্য সব অস্তিত্ব কাল্পনিক।