টোপন কিন্তু হাল ছাড়ল না। প্রতিদিন আমাকে অনুনয়-বিনয় করে সময়স্টেশনটি চালু করতে বলত। তাকে কোনো যুক্তি দিয়ে বোঝানো গেল না যে, কোনোদিনই ভবিষ্যতের মানুষ অতীতে আসবে না,-এটি একটি অসম্ভব ব্যাপার। তার অনুনয়-বিনয় শুনতে শুনতে আমাকে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হল। আমি আবার সময়-স্টেশনটি চালু করলাম। টোপনকে সুইচপ্যানেলের সামনে বসিয়ে দিয়ে আমি চলে এলাম। আসার সময় সাবধান করে দিলাম, কোনো সুইচে যেন ভুলেও চাপ না দেয়। শুধু বড় স্ক্রীনটার দিকে যেন নজর রাখে। যদি কিছু দেখতে পায় (দেখবে না জানি) তবে আমাকে যেন খবর দেয়।
এই জটিল ও মূল্যবান যন্ত্রটি সাত বছরের একটি ছেলের দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে চলে আসতে আমার কোনো দ্বিধা হয় নি। আমি জানি, বাচ্চা ছেলেদের ছেলেবেলা থেকে সত্যিকার দায়িত্ব পালন করতে দিলে তারা সেগুলি মন দিয়ে পালন করে, আর পরে খাঁটি মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। টোপনের সাথে আগেও আমি বেশ গুরুত্ব দিয়ে কথা বলতাম, প্রায় বিষয়েই আমি ওর সাথে এমনভাবে পরামর্শ করেছি, যেন সে একটি বয়স্ক মানুষ। এই সময়-স্টেশনটি তৈরি করার সময়েও কোন লিভারটি কোথায় বসালে ভালো হবে, তার সাথে আলাপ করে দেখেছি।
সারাদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে কাটিয়ে সন্ধেয় বাসায় ফিরে আসতেই বুলা আমাকে বলল, টোপন সারা দিন নাওয়া-খাওয়া করে নি। একমনে সময়স্টেশনের সামনে বসে আছে। আমি হেসে বললাম, একদিন নাওয়া-খাওয়া না করলে কিছু হয় না।
তুমি তো তাই বলবে! বুলা উষ্ণ হয়ে বলল, নিজে যেরকম হয়েছ, ছেলেটিকেও সেরকম তৈরি করছিা!
বেশ, বেশ, টোপনকে খেতে পাঠিয়ে দিচ্ছি, বলে আমি সময়— স্টেশনটিতে হাজির হলাম। অতিকায় যন্ত্রপাতির ভিতরে সুইচ প্যানেলের সামনে ছোট্ট টোপন গভীর মুখে বড় স্ক্রীনটার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। আমি পিছনে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখলাম। সে চমকে উঠে বলল, কে?
আমি। কি রে, কিছু দেখলি?
এখনও দেখি নি। তবে ঠিক দেখব। সারা দিন না খেয়ে ওর মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে।
যা, এখন খেয়ে আয়। ততক্ষণ আমি বসি।
তুমি বসবে? টোপন কৌতূহলী চোখে আমার দিকে তাকাল। আমি যাব। আর আসব, একছুটে—
একছুটে যেতে হবে না। ধীরেসুস্থে খেয়েদেয়ে আয়। সারা দিনরাত তো আর এখানে বসে থাকতে পারবি না! ঘুমোতে হবে, পড়তে হবে, স্কুলে যেতে হবে, খেলাধুলা করতে হবে।
কয়দিন খেলাধুলা করব না, স্কুল থেকে এসেই এখানে বসব। তারপর পড়া শেষ করে—
বেশ বেশ।
তুমি নাহয় আমাকে শিখিয়ে দিও কীভাবে এটি চালু করতে হয়। তা হলে তোমাকে বিরক্ত করব না।
আচ্ছা আচ্ছা, তাই দেব। এখন খেয়ে আয়।
শেষ পর্যন্ত পুরো সময়-স্টেশনটি টোপনের খেলার সামগ্ৰী হয়ে দাঁড়াল। সে সময় পেলেই নিজের এসে চালু করে চুপচাপ বসে থাকত, আর যাবার সময় বন্ধ করে চলে যেত। আমি মাঝে মাঝে এসে দেখে যেতাম। টোপনকে জিজ্ঞেস করতাম, কি রে, কিছু দেখলি?
এখনও দেখি নি, তবে ঠিক দেখব। এরই নাম বিশ্বাস। আমি মনে মনে হাসাঁতাম এরপর বহুদিন কেটে গেছে। আমি সময়-স্টেশনটির কথা ভূলেই গেছি। মাঝে মাঝে টোপন এসে আমাকে নিয়ে যেত যন্ত্রপাতি ঠিক আছে কি না পরীক্ষা করে দেখার জন্যে। খুঁটিনাটি ভুলের জন্যে ভবিষ্যতের মানুষ হাতছাড়া হয়ে গেলে তার দুঃখের সীমা থাকবে না।
সেদিন দুপুরে আমি সবে এক কাপ কফি খেয়ে কতকগুলি কাগজপত্র দেখছি, এমন সময় ঝনঝনি করে ফোন বেজে উঠল। সহকারী মেয়েটি ফোন ধরে রিসিভারটি আমার দিকে এগিয়ে দিল, আপনার ছেলের ফোন।
আমি রিসিভারে কান পাততেই টোপনের চিৎকার শুনলা, বাবা, এসেছে, এসেছে—এসে গেছে!
কে এসেছে?
ভবিষ্যতের মানুষ! তুমি তাড়াতাড়ি চলে এস।
ব্যাপারটা বুঝতে আমার সময় লাগল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি রকম মানুষ?
এখনও দেখি নি। বড় ক্ৰীনটায় এখন শুধু আলোর দাগ দেখা যাচ্ছে। প্রথমে লম্বা লম্বা থাকে, পরে হঠাৎ ঢেউয়ের মতো হয়ে যায়। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এস।
সত্যি বলছিস তো? টোপন মিথ্যা বলে না জেনেও জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, ঠিক দেখেছিস তো?
তুমি এসে দেখে যাও, মিথ্যা বলছি না কি। টোপনের গলার স্বর কাদো কাঁদে হয়ে যায়, এতক্ষণে চলেই গেল নাকি!
আমি সহকারী মেয়েটিকে বললাম, জরুরি কাজে চলে যাচ্ছি, বাসায় কেউ যেন বিরক্ত না করে। তারপর লিফুট বেয়ে নেমে এলাম।
বাসা বেশি দূরে নয়, পৌঁছুতে বেশি সময় লাগল না। টোপন আমার জন্যে বাসার গেটে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখেই পুরো ঘটনাটা হড়বড় করে দু বার বলে গেল। আমি তাকে নিয়ে সময়—স্টেশনে ঢুকে দেখি বড় স্ক্রীনটা সত্যি সত্যি আলোকতরঙ্গে ভরে যাচ্ছে। এটি হচ্ছে স্থির সময়ের ক্ষেত্রে পার্থিব বস্তুর উপস্থিতির সংকেত। আমার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। আমার সামনে সম্পূর্ণ অসম্ভব একটি ঘটনা ঘটতে চলেছে।
এখন আমার অনেক কাজ বাকি। সাহায্য করার কেউ নেই, টোপনকে নিয়েই কাজ শুরু করতে হল। প্রথমে দুটো বড় বড় জেনারেটর চালু করলাম—গুমগুমা শব্দে ট্রান্সফর্মারগুলি কোঁপে উঠল। ঝিলিক ঝিলিক করে দুটো নীল আলো ঘুরে ঘুরে যেতে লাগল। বিভিন্ন মিটারের কাঁটা কোপে কোঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল। লিভারের চাপ দিতেই সামনে অনেকটুকু জায়গায় শক্তিশালী চৌম্বকীয় ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেল। দীর্ঘদিনের জমে ওঠা ধুলাবালি আয়নিত হয়ে কাপনের সাথে সেখানে একটা ঘূর্ণির সৃষ্টি করল, এগুলি আর পরিষ্কার করার উপায় নেই।