আমি ভেবে দেখলাম, উন্মাদ কপোট্রনাটি যা বলেছিল, তার সাথে এই সিদ্ধান্তগুলির খুব বেশি একটা অমিল নেই। প্রথমবারের মতো কপোট্রনটির জন্য আমার একটু সভ্রমবোধের জন্ম হল।
এরপর আমার মাথায় ভয়ানক ভয়ানক সব পরিকল্পনা খেলা করতে লাগল। যেসব ভবিষ্যতের অভিযাত্রীরা অতীতে আসতে চাইছে আমি তাদের সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। নিঃসময়ের ক্ষেত্র থেকে বর্তমানে পৌঁছুতে যে-শক্তিক্ষয় হয় তা নিয়ন্ত্রণের যান্ত্রিক কলাকৌশল আমার মাথায় উঁকি দিতে লাগল। এই সময়-স্টেশনটি তৈরি করতে কী ধরনের রবোটের সাহায্য নেব মনে মনে স্থির করে নিলাম।
যে-উন্মাদ কপোট্রনটির প্ররোচনায় আমি এই কাজে নেমেছি, তার সাথে আবার দেখা করতে গিয়ে শুনলাম সেটিকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। যারা যুক্তিহীন ভাবনা ভালবাসে তারা নাকি প্রকৃত অর্থেই অপদার্থ। শুনে আমার একটু দুঃখ হল।
যেহেতু সময়ে পরিভ্রমণ বিজ্ঞানীদের দ্বারা স্বীকৃত নয় এবং এ বিষয়ে গবেষণার জন্য সরকারি সাহায্যের কোনো আশা নেই, সেহেতু আমি এই সময়–স্টেশনটি বাসাতেই স্থাপন করব ঠিক করলাম। যান্ত্রিক কাজে পারদশী দুটি রবোট নিয়ে এসে খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করলাম। পুরো পরিকল্পনা আমার নিজের চিন্তাপ্রসূত এবং ব্যাপারটি যে-কোনো বিষয় থেকে জটিল। কাজ শেষ হতে এক মাসের বেশি সময় লাগল। টোপন দিনরাত সব সময় স্টেশনের পাশে বসে থাকত। এটা দিয়ে ভবিষ্যতের মানুষের সাথে যোগাযোগ করা হবে শুনে সে অস্বাভাবিক কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। কোন সুইচটি কোন কাজে লাগবে এবং কোন লিভারটি কিসের জন্যে তৈরি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে তার কোনো ক্লান্তি ছিল না।
পরীক্ষামূলকভাবে যেদিন সময়-স্টেশনটি চালু করলাম, সেদিন টোপন আমার পাশে বসে। উত্তেজনায় সে ছটফট করছিল। তার ধারণা, এটি চালু করলেই ভবিষ্যতের মানুষেরা টুপটাপ করে হাজির হতে থাকবে।
একটা মৃদু গুঞ্জনধ্বনির সাথে সাথে দুটি লালবাতি বিপবিপি করে জ্বলতে লাগল। সামনে নীলাভ স্ত্রীনে আলোকতরঙ্গ বিচিত্রভাবে খেলা করছিল। আমি দুটি লিভার টেনে একটা সুইচ টিপে ধরলাম, একটা বিস্ফোরণের মতো আওয়াজ হল, এখন স্থির সময়ের ক্ষেত্রের সাথে এই জটিল সময়–স্টেশনটির যোগাযোগ হবার কথা। সেখানে কোনো টাইম মেশিন থাকলে বড় স্ক্রীনটাতে সংকেত পাব। কিন্তু কোথায় কি? বসে থাকতে থাকতে আমার বিরক্তি ধরে গেল, বড় স্ক্রীনটিতে এতটুকু সংকেতের লক্ষণ পাওয়া গেল না।
পাশে বসে থাকা টোপনকে লক্ষ করলাম। সে আকুল আগ্রহে স্ত্রীনের দিকে তাকিয়ে আছে, উত্তেজনায় বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। সে প্রতি মুহূর্তে আশা করছে এক্ষুণি একজন ভবিষ্যতের মানুষ লাফিয়ে নেমে আসবে। তাকে দেখে আমার মায়া হল, জিজ্ঞেস করলাম, কি রে টোপন, কেউ যে আসে না।
আসবে বাবা, আসবে। তাকে স্থিরপ্রতিজ্ঞ দেখাল।
কেউ যদি আসে, তা হলে তাকে তুই কী বলবি?
বলব, গুড মনিং। সে স্ক্রীন থেকে চোখ সরাল না, পাছে ভবিষ্যতের মানুষ সেই ফাঁকে স্ত্রীনে দেখা দিয়ে চলে যায়।
আচ্ছা বাবা, আমার যদি একটা টাইম মেশিন থাকে—
হুঁ।
তা হলে আমি অতীতে যেতে পারব?
কেন পারবি না। অতীত ভবিষ্যৎ সব জায়গায় যেতে পারবি।
অতীতে গিয়ে আমার ছেলেবেলাকে দেখব?
দেখবি।
আমি যখন হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতাম, তখনকার আমাকে দেখব?
দেখিবি।
আচ্ছা বাবা, অতীতে গিয়ে আমি যদি আমার হামা-দেয়া আমাকে মেরে ফেলি। তাহলে আমি এখন কোথেকে আসব?
আমি চুপ করে থাকলাম। সত্যিই তো। কেউ যদি অতীতে গিয়ে নিজেকে হত্যা করে আসে, তাহলে সে আসবে কোত্থেকে? অথচ সে আছে, কারণ সে নিজে হত্যা করেছে। এ কী করে সম্ভব? আমি ভেবে দেখলাম, এ কিছুতেই সম্ভব না।—কাজেই অতীতে ফেরাও সম্ভব না। টাইম মেশিনে করে ভবিষ্যতের মানুষ অতীতে ফিরে আসবে, এসব কল্পনাবিলাস। আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। একটি উন্মাদ কপোট্রনের প্ররোচনায় এতদিন শুধু শুধু পরিশ্রম করেছি, অকাতরে টাকা ব্যয় করেছি? রাগে দুঃখে আমার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হল। লিভার ঠেলে সুইচ টিপে আমি সময়স্টেশনটি বন্ধ করে দিলাম।
বাবা, বন্ধ করলে কেন? টোপন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
তোর প্রশ্ন শুনে। তুই যে-প্রশ্নটি করেছিস সেটি আমার আগে মনে হয় নি, তাই।
টোপন্ন কিছু না বুঝে বলল, কি প্রশ্ন?
ঐ যে তুই জিজ্ঞেস করলি, অতীতে নিজেকে মেরে ফেললে পরে কোথেকে আসব? তাই অতীতে যাওয়া সম্ভব না, টাইম মেশিন তৈরি সম্ভব না–
টোপনের চোখে পানি টলমল করে উঠল। মনে হল এই প্রশ্নটি করে আমাকে নিরুৎসাহিত করে দিয়েছে বলে নিজের উপর ক্ষেপে উঠেছে। আমাকে অনুনয় করে বলল, আর একটু থাক না বাবা।
থেকে কোনো লাভ নেই। আয় যাই, অনেক রাত হয়েছে।
টোপন বিষণ্ণমুখে আমার পিছনে পিছনে আসতে লাগল। আমি বুঝতে পারলাম সময়ে পরিভ্রমণের উপরে কেন এতদিন কোনো কাজ হয় নি। সবাই জানত এটি অসম্ভব। ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে এলে অতীত পরিবর্তিত হয়ে যায়, কিন্তু বাস্তব জগতের পরিবর্তন—তা অতীতই হোক আর ভবিষ্যৎই হোক, কোনো দিনই সম্ভব নয়। আমি প্রথমে উন্মাদ কপোট্রনটির উপর, পরে নিজের উপর ক্ষেপে উঠলাম। কম্পিউটারগুলিকে কেন যে বাস্তব সম্ভাবনার কথা জিজ্ঞেস করি নি, ভেবে অনুতাপ হল। কিন্তু তাতে লাভ কী আমার, এই অযথা পরিশ্রম আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।