কেন?
এই কপোট্রনগুলি স্বাভাবিক নয়। সব কপোট্রনই কিছু কিছু যুক্তিতর্ক মেনে চলে। এগুলির সেরকম কিছু নেই।
মানে? ওরা তাহলে আবোল-তাবোল বকে?
অনেকটা সেরকমই। ভদ্রলোক হাসলেন। ওদের কল্পনাশক্তি অস্বাভাবিক। ঘোর অযৌক্তিক ব্যাপারও বিশ্বাস করে এবং সে নিয়ে রীতিমতো তর্ক করে।
এগুলি তৈরি করে লাভ? এ তো দেখছি উন্মাদ কপোট্রন।
তা, উন্মাদ বলতে পারেন। কিন্তু এদের দিয়ে কোনো লাভ হবে না জোর দিয়ে বলা যায় না। বলগা ছাড়া ভাবনা যদি না করা হত, পদার্থবিদ্যা কোনোদিন ক্লাসিক্যাল থেকে রিলেটিভিস্টিক স্তরে পৌঁছুত না।
তা বটে। আমি মাথা নাড়ুলাম। কিন্তু তাই বলে ইচ্ছে করে পাগল কপোট্রন তৈরি করবেন?
আপনি আলাপ করে দেখুন না, আর কোনো লাভ হোক কি না-হোক, নির্ভেজাল আনন্দ তো পাবেন।
আমি একটা কপোট্রনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কি হে?
নাম? নামের প্রয়োজন কী? ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থাকলে নামের প্রয়োজন হয় না-যন্ত্রণা পিয়ে পরিচয় পাওয়া যায়। লাল নীল যন্ত্রণারা রক্তের ভিতর খেলা করতে থাকে….
সাহিত্যিক ধাঁচের মনে হচ্ছে? আমি ডিরেক্টর ভদ্রলোকের দিকে তাকোলাম।
হ্যাঁ। এটি সাহিত্যমান। একটা-কিছু জিজ্ঞেস করুন।
আমি কপোট্রনটিকে জিজ্ঞেস করলাম, যন্ত্রণারা আবার লাল নীল হয় কেমন করে?
যন্ত্রণারা সব রংয়ের হতে পারে, সব গন্ধের হতে পারে, এমনকি সবকিছুর মতো হতে পারে। যন্ত্রণার হাত-পা থাকে, চোখ থাকে-ফুরফুরে প্রজাপতির মতো পাখা থাকে। সেই পাখা নাড়িয়ে যন্ত্রণার আরো বড় যন্ত্রণায় উড়ে বেড়ায়। উড়ে উড়ে যখন ক্লান্তি নেমে আসে, তখন–
তখন?
তখন একটি একটি লাল ফুলের জন্ম হয়। সব নাইটিংগেল। তখন সবগুলো ফুলের কাঁটায় বুক লাগিয়ে রক্ত শুষে নেয়—লাল ফুল সাদা হয়ে যায়, সাদা ফুল লাল…
বেশ বেশী। আমি দ্রুত পাশের কপোট্রনের কাছে সরে এলাম।
এটিও কি ওটার মতো বদ্ধ পাগল?
না, এটা অনেক ভালো। এটি আবার বিজ্ঞানমনা। যুক্তিবিদ্যা ছাড়া তো বিজ্ঞান শেখানো যায় না, কাজেই এর অল্প কিছু যুক্তিবিদ্যা আছে। তবে আজগুবি আজগুবি সব ভাবনা এর মাথায় খেলতে থাকে।
আমি কপোট্রনটির পাশে দাঁড়ালাম। জিজ্ঞেস করলাম, বলতে পার বিজ্ঞান-সাধনা শেষ হবে কবে?
এই মুহূর্তে হতে পারে। একটু চেষ্টা করলেই।
আমি ডিরেক্টর ভদ্রলোকের দিকে তোকালাম, তবে না বলছিলেন এটা যুক্তিপূর্ণ কথা বলবে?
ওর বক্তব্যকে ব্যাখ্যা করতে বলুন দেখি।
আমি কপোট্রনটিকে বললাম, বিজ্ঞান-সাধনা শেষ হওয়া আমি দর্শন বা অন্য কোনো দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলি নি। আমি সাদা কথায় জানতে চাই বিজ্ঞান-সাধনা বা প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন কবে শেষ হবে?
বললাম তো, ইচ্ছে করলে এখনই।
কীভাবে?
ভবিষ্যতের শেষ সীমানা থেকে টাইম মেশিনে চড়ে কেউ যদি আজ এই অতীতে ফিরে আসে, আর তাদের জ্ঞান-সাধনার ফলাটুকু বলে দেয়, তা হলেই তো হয়ে যায়। আর কষ্ট করে জ্ঞান-সাধনা করতে হয় না।
আমি বোকার মতো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, কিন্তু আমরা কী করতে পারি? ভবিষ্যৎ থেকে কেউ যদি না আসে?
নিশ্চয়ই আসবে। কপোট্রনটি যুক্তিহীনভাবে চেঁচিয়ে উঠল। ভবিষ্যতের লোকেরা নিশ্চয়ই বর্তমান কালের জ্ঞানের দুরবস্থা অনুভব করবে। এর জন্যে কাউকে-না–কাউকে জ্ঞানের ফলসহ না পাঠিয়ে পারে না।
সেই আশায় কতকাল বসে থাকিব?
লক্ষ বছর বসে থেকেও লাভ নেই। অথচ পরিশ্রম করলে এক মাসেও লাভ হতে পারে।
কি রকম?
যারা ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে আসবে তারা তাদের কাল থেকে নিঃসময়ের রাজত্বে ঢুকবে নিজেদের যান্ত্রিক উৎকর্ষ দিয়ে, কিন্তু নিঃসময়ের রাজত্ব থেকে বর্তমানকালে পৌঁছুবে কীভাবে? কে তাদের সাহায্য করবে? পৃথিবী থেকে কেউ সাহায্য করলেই শুধুমাত্র সেটি সম্ভব।
তোমার কথা কিছু বুঝলাম না। নিঃসময়ের রাজত্ব কি?
নিঃসময় হচ্ছে সময়ের সেই মাত্রা, যেখানে সময়ের পরিবর্তন হয় না।
এসব কোথা থেকে বলিছ?
ভেবে ভেবে মন থেকে বলছি।
তাই হবে। এ ছাড়া এমন আষাঢ়ে গল্প সম্ভব।
আমি ডিরেক্টর ভদ্রলোককে বললাম, চলুন যাওয়া যাক। আপনার কপোট্রনদের সাথে চমৎকার সময় কাটল। কিন্তু যা-ই বলুন-আমি না বলে পারলাম না, এগুলি শুধু শুধু তৈরি করেছেন, কোনো কাজে লাগবে না।
আমারও তাই মনে হয়। তাঁকে চিন্তিত দেখায়, যুক্তিহীন ভাবনা দিয়ে লাভ নেই।
ফার্ম থেকে বাসায় ফেরার সময় নির্জন রাস্তায় গাড়িতে বসে বসে আমি কপোট্রনটির কথা ভেবে দেখলাম। সে যেসব কথা বলছে, তা অসম্ভব কল্পনাবিলাসী লোক ছাড়া বলা সম্ভব নয়। কিন্তু ব্যাপারটি কি শুধুই কল্পনাবিলাস? কথাগুলোর প্রমাণ নেই, কিন্তু যুক্তি কি একেবারেই নেই? আমি ভেবে দেখলাম, ভবিষ্যৎ থেকে কেউ এসে হাজির হলে মানবসভ্যতা এক ধাপে কত উপরে উঠে যেতে পারে। কিন্তু কপোট্রনের ঐ নিঃসময়ের রাজত্বটাজত্ব কথাগুলি একেবারে বাজে, শুধু কল্পনা করে কারো এরকম বলা উচিত না, তবে ব্যাপারটি কৌতূহলজনক। সত্যি সত্যি একটু ভেবে দেখলে হয়।
পরবর্তী কয়দিন যখন আমি অতীত, ভবিষ্যৎ, চতুর্মাত্রিক জগৎ, আপেক্ষিক তত্ত্ব ইত্যাদি নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম, তখন মাঝে মাঝে আমার নিজেরই লজ্জা করত, একটি ক্ষ্যাপা কপোট্রনের কথা শুনে সময় নষ্ট করছি ভেবে। এ বিষয় নিয়ে কেন জানি আগে কেউ কোনোদিন গবেষণা করে নি। সময়ে পরিভ্রমণ সম্পর্কে আমি মাত্র একটি প্ৰবন্ধ পেলাম এবং সেটিও ভীষণ অসংবদ্ধ। বহু পরিশ্রম করে উন্নতশ্রেণীর কয়েকটি কম্পিউটারকে নানাভাবে জ্বালাতন করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌছানো গেল। সেগুলি হচ্ছে, প্রথমত উপযুক্ত পরিবেশে সময়ের অনুকূল কিংবা প্রতিকূলে যাত্রা করে ভবিষ্যৎ কিংবা অতীতে যাওয়া সম্ভব। দ্বিতীয়ত, সময়ের স্লোতে যাত্রার পূর্বমুহূর্তে ও শেষমূহুর্তে অচিন্তানীয় পরিমাণ শক্তিক্ষয়ের প্রয়োজন। সেই মুহুর্তে শক্তিক্ষয় নিয়ন্ত্রণ না করলে পুরো মাত্রা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, এবং তৃতীয়ত, যাত্রার পূর্ব ও শেষমূহুর্তের মধ্যবর্তী সময় স্থির সময়ের ক্ষেত্ৰ। এই ক্ষেত্রে পরিভ্রমণে কোনো শক্তির প্রয়োজন নেই।