বুলা! আমি আর্তম্বরে চিৎকার করে উঠলাম। সে হঠাৎ তীব্র দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকাল, তারপর বলল, তুমি মিথ্যা কথা বললে কেন?
কি?
তুমি বলেছ। আমি বুলা, আসলে আমি একটা রবোট। তারপর ও হঠাৎ আকুল হয়ে হু-হু করে কোঁদে উঠল।
আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম-আমার এত চেষ্টার পরও বুলা সব জেনে গেছে। হঠাৎ কেন জানি অসহায় বোধ করলাম, আমার কিছু করার নেই। বুলার ক্ষতিগ্রস্ত মস্তিষ্ক বদলে আমি একটি কপোট্রন লাগিয়ে দিয়েছিলাম। ওর মস্তিষ্ক কোনোভাবেই সারানো যেত না, তাই আমি এই বিকল্পটি বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু সত্যি সত্যিই তো ও বুলা হয়েছিল! গভীর বেদনায় আমার বুক টনটন করে ওঠে। আমি ডাকলাম, বুলা!
বুলার চোখ ধক করে জ্বলে উঠল। বলল, বল রবোট!
না—আমি চিৎকার করে উঠলাম। বুলা, পাগল হয়ো না। আমার কথা শোন। তোমায় কে বলেছে তুমি রবোট?
টোপনের বিজ্ঞানমেলায় একটা মেটাল ডিটেকটর ছিল, বুলা কান্না সামলে বলতে থাকে, আমি কাছে যেতেই সেটি টিকটিক করে উঠল। তারপর আমি গিয়েছি কপোট্রনের ফার্মে। ওরা বলেছে, আমার মাথায় মস্তিষ্ক নেই, তার বদলে পারমাণবিক ক্যাটারিসহ একটা কপোট্রন কাজ করছে।
আমি ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। তারপর বললাম, তাতে ক্ষতি হয়েছে কি? তুমি কাঁদাছ কেন?
তবে কি হাসব? আনন্দে চিৎকার করব? বুলা কান্না সামলাতে সামলাতে বিকৃত স্বরে বলল, কী আশ্চর্য! আমি তুচ্ছ একটা রবোট, অথচ আমি ভাবছি আমি বুলা, টোপনের মা, তোমার স্ত্রী–কুলা কান্নার বেগ সামলাতে ঠোঁট কামড়ে ধরল।
আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। এত কষ্ট করে বুলার দেহে আমি আবার বুলাকে ফিরিয়ে এনেছিলাম। আমার সামনেই তা আবার ধ্বংস হয়ে যাবে? আমি বুলাকে দু হাত ধরে ঝাঁকুনি দিলাম, তারপর চিৎকার করে ডাকলাম, বুলা।
কি? ওর সারা মুখ চোখের পানিতে ভেসে যাচ্ছে।
শোন বুলা, তুমি যদি এখনও এরকম কর—আমি তীব্র স্বরে বললাম, তা হলে এক্ষুনি তোমাকে অজ্ঞান করে ফেলব।
বুলা বাষ্পাচ্ছন্ন চোখে আমার দিকে তাকাল।
হ্যাঁ। তোমাকে অজ্ঞান করে আবার তোমার মাথায় নূতন কপোট্রন বসাব, আবার নূতন করে তোমার মাঝে বুলাকে ফিরিয়ে আনব…
বুলা বিশ্বফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বলে চললাম, তোমাকে আমার চাই-ই চাই। তোমার জন্যে শোন বুলা, শুধু তোমার জন্যে আমি তোমার ধ্বংস হয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক বদলে নূতন কপোট্রন বসিয়েছি। তোমার ক্ষুধা আছে, তৃষ্ণা আছে, ভালবাসা আছে। তোমার টোপন আছে, আমি আছি—তবু তুমি এরকম করছ?
তুমি বুকে হাত দিয়ে বল, তোমার বুকে আমার জন্য ভালবাসা নেই? টোপন তোমার ছেলে না? থাকুক তোমার মাথায় কপোট্রন। মানুষ কৃত্রিম চোখ, কৃত্রিম হাতপা, ফুসফুস নিয়ে বেঁচে নেই? তবে কেন পাগলামি করছ?
কথা বলতে বলতে আমার সব আবেগ স্রোতের মতো বেরিয়ে আসতে লাগল। কে জানত আমার ভিতরে এত আবেগ লুকিয়ে ছিল।
তোমার নিজেকে তুমি জিজ্ঞেস করে দেখ, তুমি বুলা কি না। বুলার চোখ, মুখ, হাতু, পা, চুল—সবকিছু বুলার, শুধু তোমার মস্তিষ্কটি কৃত্রিম, তাতে যে-অনুভূতি, সেটি পর্যন্ত বুলার, আমি নিজের হাতে ধীরে ধীরে তৈরি করেছি। তবু তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছ।
আমার কী স্বাৰ্থ? তোমাকে প্ৰাণ দেয়ার আমার কী স্বাৰ্থ? রবোটের সাহায্যে তোমার মস্তিষ্ক বদলে মানবিক আবেগসম্পন্ন কপোট্রন তৈরি করে সেখানে বসানোতে আমার কী স্বাৰ্থ? শুধু তোমাকে পাওয়া-তোমাকে তোমাকে তোমাকে…
আমি বাষ্পাচ্ছন্ন চোখে বুলাকে তীব্র ঝাঁকুনি দিতে লাগলাম।
বুলা আমার বুকে মাথা গুঁজে বলল, তাহলে আমিই বুলা?
হ্যাঁ, তুমিই বুলা। পৃথিবীতে আর কোনো বুলা নেই।
টোপনি আমার ছেলে?
হ্যাঁ। টোপন তোমার ছেলে, তোমার আর আমার।
তুমি আমার—
আমি তোমার?
বুলা উত্তর না দিয়ে হাসল। আমি ওর চুলে হাত বোলাতে লাগলাম। এই চুলের আড়ালে বুলার মাথায় একটি কপোট্রন লুকানো আছে। কিন্তু ক্ষতি কি? এই কপোট্রন আমাকে ভালবাসে, টোপনকে স্নেহ করে, আনন্দে হাসে, দুঃখ পেলে কাঁদে। হলই-বা কপোট্রন!
আমি বুলাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম।
০৬. কপোট্রনিক ভবিষ্যৎ
বিকেলে আমার হঠাৎ করে মনে হল আজ আমার কোথায় জানি যাবার কথা। ভোরে বারবার করে নিজেকে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু এখন আর মনে করতে পারছি না। আমি একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম, তবে বিশেষ চিন্তিত হলাম না। আমি ঠিক জানি, আমার মস্তিষ্কও কপোট্রনের মতো পুরানো স্মৃতি হাতড়ে দেখতে শুরু করেছে, মনে করার চেষ্টা না করলেও ঠিক মনে হয়ে যাবে।
বৈকলিক চা খাওয়ার সময় আমার মনে পড়ল আজি সন্ধেয় একটি কপোট্রন প্ৰস্তুতকারক ফার্মে যাবার কথা। ডিরেক্টর ভদ্রলোক ফোন করে বলেছিলেন, তাঁরা কতকগুলি নিরীক্ষামূলক কপোট্রন তৈরি করেছেন, আমি দেখলে আনন্দ পাব। কিছুদিন আগে এই ডিরেক্টরের সাথে কোনো—এক বিষয়ে পরিচয় ও অল্প কিছু হয়েছিল। এখন মাঝে মাঝেই নৃতন রবোট তৈরি করলে আমাকে ফোন করে যাবার আমন্ত্রণ জানান।
ফার্মটি শহরের বাইরে, পৌঁছুতে একটু দেরি হয়ে গেল। লিফটে করে সাততলায় ডিরেক্টরের ঘরে হাজির হলাম। তিনি খানিকক্ষণ শিষ্টতামূলক আলাপ করে আমাকে তাঁদের রিসার্চ সেন্টারে নিয়ে গেলেন। ভেবেছিলাম। সদ্যপ্ৰস্তুত ঝকঝকে কতকগুলি রবোট দেখব, কিন্তু সেরকম কিছু না। বিরাট হলঘরের মতো ল্যাবরেটরিতে ছোট ছোট কালো টেবিলের উপর কাচের গোলকে কপোট্রন সাজিয়ে রাখা হয়েছে। একপাশে একটি প্রিন্টিং মেশিন, অপর পাশে মাইক্রোফোন, প্রশ্ন করলে উত্তর বলে দেবে কিংবা লিখে দেবে। দেয়ালে কিছু বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, চৌকোণা ট্রান্সফর্মার, দেখে মনে হল এখান থেকে উচ্চচাপের বৈদ্যুতিক প্রবাহ দেয়া হয়। কপোট্টনের সামনে লম্বাটে মাউথপীস। ঠিক একই রকম বেশ কয়টি কপোট্রন পাশাপাশি সাজানো। আমি জিজ্ঞাসু চোখে ডিরেক্টর ভদ্রলোকের দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, রবোটের শরীরের সাথে এখনও জুড়ে দিই নি,-দিতে হবেও না বোধহয়।