আমি তাকে তার ছেলেবেলার গল্প করলাম। একসময় সেগুলি তার মুখেই শুনেছিলাম। তারপর তার ছাত্রজীবনের গল্প করে শোনালাম, ব্যক্তিগত ডাইরি, কিছু চিঠিপত্র খুব কাজে দিল। শেষে তার সাথে আমার বিয়ের পুরো ঘটনাটি বললাম। শুনতে শুনতে ও লজ্জা পেল, হাসল, তারপর আস্তে আস্তে বলল, কী বোকা ছিলাম!
সবশেষে ওকে ওর অ্যাকসিডেন্টের ঘটনাটি শোনালাম। ও নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনে গেল। ডাক্তারদের অপারগতার কথা শুনতে শুনতে ওর চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। আমার একরোখা বিশ্বাস আর জোর করে বাঁচিয়ে তোলার ঘটনা শুনতে শুনতে ওর চোখ কৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে বলে, কেন বাঁচালে আমাকে?
বাঃ! তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচিব কেমন করে?
বুলা সরলভাবে হাসে। বলে, ভাগ্যিস তুমি ছিলে, নইলে কবে মরে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াতাম!
আমার সবরকম পরামর্শ শুনে শুনে ও ঠিক আগের বুলা হয়ে উঠতে থাকে। একদিন টেপ রেকর্ডারে ওর দুর্ঘটনার আগে টেপ করে রাখা গান শুনে বুলা অবাক হয়ে যায়। বলে, আমি নিজে গেয়েছিলাম?
হ্যাঁ। তুমি চমৎকার গান গাইতে পারতে। এখনও নিশ্চয়ই পার।
যাঃ।
সত্যি। চেষ্টা করে দেখ। গাও দেখি–
বুলা প্রথমে একটু লজ্জা পায়, তারপর চমৎকার সুরেলা কণ্ঠে গান গেয়ে ওঠে।
একদিন হঠাৎ বলল, আচ্ছা, আমি কি আগের থেকে খুব বদলে গেছি?
তা তো গিয়েছ অল্প কিছু। এত বড় একটা দুর্ঘটনা—
আমাকে শুধরে দিও, আমি ঠিক আগের মতো হতে চাই।
বেশ। আমি বুলাকে খুঁটিনাটি সব বিষয় শুধরে দিই—আর ও ঠিক আগের বুলা হয়ে উঠতে থাকে।
একদিন ওকে আমি টোপনের কথা বললাম। ও অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে চোখ বড় বড় করে শুনল, তারপর ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞেস করল, আমার ছেলে?
হ্যাঁ, আমাদের ছেলে।
সত্যি বলছি? আমার-মানে আমার নিজের ছেলে?
হ্যাঁ, তোমার নিজের ছেলে।
ওর নাম কি? কী রকম দেখতে? কত বড়?
আস্তে আস্তে! আমি বুলাকে শান্ত করি, দেখতেই তো পাবে।
কখন দেখব? কোথায় আছে?
নার্সরি স্কুলে। কাল নিয়ে আসব।
না না, কাল নয়, এক্ষুণি নিয়ে এস। কত বড়? কি নাম?
পাঁচ বছর বয়স। টোপন নাম।
টোপন?
হ্যাঁ।
আমাকে দেখলে চিনতে পারবে?
বাঃ! মাকে বুঝি ছেলেরা চিনতে পারে না।
সত্যি চিনতে পারবে তো? আমি যে চিনি না। বুলার কণ্ঠস্বর করুণ হয়ে ওঠে।
আমি সত্ত্বনা দিই, তাতে কী হয়েছে, একবার দেখলেই চিনে ফেলবে, আর কখনো ভুলবে না।
তুমি নিয়ে এস। বুলা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আর হাত আঁকড়ে ধরে বলে, আমার ছেলেকে দেখব।
তবু আমি দেরি করতে থাকি, আর চোখের সামনে বুলা মা হয়ে উঠে। টোপনের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে।
টোপনকে নিয়ে আসার পর সে তার মাকে দেখে একমুহূৰ্ত থমকে দাঁড়াল। তারপর চিৎকার করে বুলার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বুলার বুকে মুখ গুঁজে জড়িত স্বরে আমার বিরুদ্ধে একরাশ নালিশ করতে থাকে, আমি কীভাবে তাকে তার মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছি বলতে বলতে তার চোখ বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। বুলা বিস্ফারিত চোখে টোপনকে আকড়ে ধরে, তারপর ফিসফিস করে বলে, কী আশ্চর্য! আমার ছেলে! আমার নিজের ছেলে।
আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।
দীর্ঘ দু বছর সময়ে বুলা ধীরে আগের বুলা হয়ে ওঠে। ও এখন ঠিক আগের মতো গান গাইতে পারে, ঠিক আগের মতো হাসে, আগের মতো হঠাৎ হঠাৎ অদ্ভুত সব কবিতার লাইন আউড়ে ওঠে। সারাদিন পরিশ্রম করে ফিরে এলে ও গভীর মমতায়। আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তাকিয়ে থাকে। দুঃস্বপ্নের মতো অসহায় অচেতন স্মৃতিহারা বুলাকে আমি দ্রুত ভুলে যেতে থাকি।
ও এখন ঠিক আগের বুলা হয়ে উঠেছে—শুধু একটি বিষয় ছাড়া। ওকে আমি বিজ্ঞানবিষয়ক একটি অক্ষরও শেখাই নি। কেন জানি আমার ধারণা হয়েছে, নিষ্ঠুর বিজ্ঞান বুলার জন্যে নয়, বুলা অফুরন্ত মমতার উৎস–ভালবাসার ধারা।
সেদিন টোপন, ওর বয়স এখন সাত, এসে বলল, ওদের স্কুলে বিজ্ঞানমেলা। আমাকে আর বুলাকে যেতে হবে। আমার অনেক কাজ, স্কুলের ছেলেমানুষি বিজ্ঞানমেলায় যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, বুলা যাক, সেটিও আমার ঠিক ইচ্ছে নয়। কিন্তু টোপনকে সেকথা বোঝাবে কে? টোপন বহু আগে থেকেই তার মার কাছে অনেক গল্প করে রাখল।
আমরা নিজেরা টেলিস্কোপ তৈরি করেছি। মঙ্গল গ্রহের দুটো চাঁদই সেটা দিয়ে দেখা যায়।
সত্যি।
হ্যাঁ। একটা ডিমোস, আরেকটার নাম ফোবোস।
বাঃ। বুলা ওকে উৎসাহ দেয়।
ইলেকট্রন মাইক্রোঙ্কোপও তৈরি করেছি।
যাঃ।
সত্যি। বিশ্বাস করা। সবচেয়ে আশ্চর্য হচ্ছে একটা রবোট। তুমি গেলে তোমার সাথেও কথা বলবে। সেখানে ভিড় সবচেয়ে বেশি।—তবু তোমাকে ঠিক আমি নিয়ে যাব। আমি আবার ক্যাপ্টেন কিনা।
কাজেই বুলাকে টোপন বিজ্ঞানমেলায় নিয়ে গেল। আমি গেলাম অফিসে, মনে খানিকটা অস্বন্তি কেন জানি খচখচ করতে লাগল।
সন্ধেয় ফিরে এসে দেখলাম বাসা অন্ধকার। একটু অবাক হয়ে সিঁড়ি বেয়ে শোবার ঘরে হাজির হলাম। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে দেখলাম, জানালার কাছে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।
কে?
কোনো কথা না-বলে মূর্তিটি খুব ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, সেটি বুলা পরনের কাপড় অবিন্যস্ত, চুল এলোমেলো। দু চোখ টকটকে লাল আর গাল বেয়ে চোখের পানির শুকনো ধারা। আমি বিক্ষিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, বুলা, কী হয়েছে?
বুলা পাথরের মতো চুপ করে রইল। আমার প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না।