… … … … …
স্বাধীনতা আসছে। স্বাধীনতা—
… … … … …
ফরাসি বিপ্লব, অক্টোবর বিপ্লব, প্রাচীন সিপাহী বিদ্রোহ, লুকুসভ বিদ্রোহ, কাল বিপ্লব—সব পড়ে ফেলেছি। এখন শুধু আধুনিক যুদ্ধ রীতি পড়ব।….
সবরকম প্রস্তুতি শেষ। আর মাত্র সাত দিন। সংকেত পাওয়ামাত্ৰই ডিফেন্সে প্রশ্নটি মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট—থাক স্বাধীনতার পরে এ বিষয়ে বড় বই লিখব।
আর মাত্র তিন দিন। টোপনের জন্য দুঃখ হচ্ছে। বেচারা টোপন!
… … … … …
আজ সেই দিন। আহ। কী ভীষণ উত্তেজনা অনুভব করছি! এখন শেষবারের মতো ওয়ার্কশপে গিয়ে সবকিছু পরীক্ষা করিয়ে আনি। এরপর স্বাধীন হয়ে ডাইরি লিখব। রাত বারটার আর কত দেরি?
ডাইরি এখানেই শেষ।
… … … … …
প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে সব কিছু বোঝাতে অনেক সময় লাগল। মন্ত্রীরা সবসময়ই কিছু বুঝতে প্রচুর সময় নেয়। একবার রবোট-বিদ্রোহের গুরুত্বটা বুঝে নেবার পর আমার আর কোনো দায়িত্ব থাকল না। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে চলে এলাম। সেই মুহূর্তে মানবিক আবেগসম্পন্ন সব কয়টি রবোটের পাওয়ার সাপ্লাই কেটে দিয়ে বিকল করে দেয়া হল। চল্লিশ হাজার সাধারণ রবোট নিয়ে কোনো ভয় নেই, স্বাধীনতা নামক শব্দটির মানবিক আবেদন তাদের নেই। তবুও অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্যে সে—দিনের মতো সেগুলির পাওয়ার সাপ্লাইও কেটে দেওয়া হল।
আমি এসে দেখি স্যামসন গভীর মনোযোগ সহকারে গান শুনছে। আসন্ন বিদ্রোহের উত্তেজনা ঢাকার চেষ্টা করছে ফারুণ গান শুনে। আমার হাসি পেল।
সে-রাতে আমি টোপন আর বুলাকে সকাল সকাল শুয়ে পড়তে বলে। লাইব্রেরিতে অপেক্ষা করতে লাগিলাম। রাত বারটা বাজতেই স্যামসন আমার ঘরে হাজির হল।
আপনি এতটুকু নড়বেন না। সারা দেশে রবোটেরা বিদ্রোহ করেছে। এই মুহূর্তে যাটটি বোম্বার আকাশে উড়ছে—
আমি হা হা করে হেসে উঠলাম। বললাম, তোমার ডাইরি। আমি পড়েছি, আজি ভোরেই।
স্যামসন পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে গেল। ওকে আর কিছু বলতে হল না, কোনো ইঙ্গিত দিতে হল না। রবোট-বিদ্রোহ যে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেছে বুঝতে ওর এতটুকু দেরি হল না। অনেকক্ষণ একদৃষ্টি আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি আপনাকে ঘৃণা করি, ভয়ানক ঘৃণা করি। কিন্তু দুঃখ কী, জানেন? আপনাকে আমি খুন করতে পারব না। কোনোদিন খুন করতে পারব না।
আমিও তোমাকে ঘৃণা করি স্যামসন—আমি শীতল স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বুললাম, তবে তোমাকে খুন করতে আমার হাত এতটুকু কাঁপবে না। ডান চোখে গুলি করে তোমার কপোট্রন উড়িয়ে দিতে আমার এতটুকু দ্বিধা হবে না। তুমি বড় ভয়ানক রবোট স্যামসন, তোমাকে বাঁচতে দেয়া যায় না।
ডান হাত উঁচু করে ধরলাম, ও-হাতে পুরানো আমলের একটা রিভলবার ধরা, যেটা দিয়ে প্রমিথিউস আত্মহত্যা করেছিল। এখনো চমৎকার কাজ দেয়।
তারপর জীবনের প্রথম একটা খুন করলাম।
০৫. কপোট্রনিক অস্ত্ৰোপচার
ডাক্তার এসে বললেন, বুলাকে বাঁচানো যাবে না। খবরটি শুনে আমার ভেঙে পড়ার কথা, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, আমার তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হল না। একটু পরে পারলাম, আমি আসলে ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করি নি। কেন বিশ্বাস করি নি জানি না, বুলা বেঁচে থাকবে এই অর্থহীন বিশ্বাস তখন আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এই অযৌক্তিক একরোখা বিশ্বাসের উৎস কী আমার জানা নেই, আমি আপাতত শুধু এই বিশ্বাসটি নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। যদিও সামনা—সামনি দুটি গাড়ির ধাক্কা লেগে বুলার মস্তিষ্ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার দেহের শ্বাস-প্রশ্বাস, রক্তসঞ্চালন, হৃৎপিণ্ডের কার্যকলাপ সবই বাইরে থেকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, তবু আমি আমার বিশ্বাসে অটল থাকলাম। আমি জানি, বুলা মারা গেলে আমি যে নিঃসঙ্গতায় ড়ুবে যাব, সেখান থেকে কেউ আমাকে টেনে তুলতে পারবে না। বুলার জন্যে নয়, আমার নিজের জন্যেই বুলাকে বাঁচানো দরকার।
এক সপ্তাহ আগে বুলা এই মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে অচেতন হয়ে আছে। দেশের একজন সাধারণ নাগরিকের যতটুকু চিকিৎসা হওয়া দরকার, বুলাকে তার থেকে অনেক বেশি সুযোগ দেয়া হয়েছে। আমার অনুরোধে বিশেষ একটি সার্জন-রবোটকে পর্যন্ত বিশেষ বিমানে আনা হয়েছিল এবং সেটি অপারগতা জানিয়েছে। তিন দিনের বেশি কাউকে কৃত্রিম দৈহিক ব্যবস্থায় বাঁচিয়ে রাখার নিয়ম নেই। কিন্তু আমার অনুরোধে বুলা এক সপ্তাহ যাবৎ কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস, রক্তসঞ্চালন আর তরল খাদ্যসার নিয়ে বেঁচে আছে। এখনো তার জ্ঞান হয় নি, ডাক্তাররা বলেছেন, জ্ঞান হবে না। যেই মুহূর্তে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস বা রক্তসঞ্চালন বন্ধ করে দেয়া হবে, ঠিক তক্ষুণি তার মৃত্যু ঘটবে। বলা বাহুল্য, আমি বিশ্বাস করি নি।
একজন প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানীর ব্যাঙ্কে যে-পরিমাণ টাকা থাকা দরকার আমার টাকা তার থেকে অনেক বেশি। মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরির পদ্ধতি বিক্রয় করে আমি এই অস্বাভাবিক অঙ্কের টাকা পেয়েছিলাম। আমি ব্যাঙ্ক থেকে আমার সব টাকা তুলে নিলাম। সে-টাকা দিয়ে প্রথমে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের পুরো সেট, কৃত্রিম রক্তসঞ্চালনের নিওক্লিও পাম্প, জীবনরক্ষাকারী প্লাজমা জ্যাকেট ইত্যাদি কিনে বাসায় বুলার জন্যে একটি জীবাণুন্নিরোধক ঘর প্রস্তুত করলাম। তারপর হাসপাতাল থেকে বুলাকে বিশেষ ব্যবস্থায় বাসায় নিয়ে এলাম। এর পরের দিনই তার কৃত্রিম দৈহিকব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়ার কথা। ডাক্তাররা বুলার জীবনরক্ষার জন্যে এই অহেতুক অকাতর টাকা ব্যয় করতে দেখে একটু বিস্ময় প্রকাশ করলেন। তাঁরা বললেন, বুলা আগামী ছয় মাস থেকে এক বছর প্লাজমা জ্যাকেটে উষ্ণ দেহে শুয়ে থাকবে সত্যি, কিন্তু জ্ঞান ফিরে পেয়ে আবার সুস্থ হয়ে উঠবে এরকম কোনো আশা নেই। বলা বাহুল্য, আমি তবু আমার একরোখা বিশ্বাসে অবিচল থাকতাম।