মাঝে মাঝে এমন কতকগুলি ঘটনা ঘটে, যা ঘটার সম্ভাবনা এত কম থাকে যে সেগুলিকে ভাগ্যের ফের বলে ধরে নেয়া হয়। আমি ভাগ্য বা ঈশ্বর বিশ্বাস করি না। কাজেই ভয়ানক অবাস্তব ঘটনা ঘটলেও আমি সেটার কোনো অলৌকিক ব্যাখ্যা দিই না। কারণ আমি জানি, কোনো ঘটনা যত অবাস্তবই হোক, তা ঘটার সম্ভাবনা কম হতে পারে, কিন্তু কখনো শূন্য নয়। কাজেই আপাতদৃষ্টিতে যেটিকে অলৌকিক মনে হয়, সেরকম ঘটনা কখনো ঘটবে না—একথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না।
সে-দিন অনেকগুলি কম সম্ভাবনার ঘটনা একসাথে ঘটিল। সেগুলি পরবর্তী এক বিপর্যয্যের সাথে এমনভাবে সম্পর্কযুক্ত যে আমার স্ত্রী বুলা পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সেগুলিকে ঈশ্বরের আশীৰ্ব্বাদ হিসেবে মনে করে।
ঘটনাগুলি হচ্ছে—
এক বিশেষ কাজ থাকা সত্ত্বেও কেন জানি আমি সে-দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে যাই নি।
দুই। স্যামসন তার ঘর খালি রেখে ওয়ার্কশপে গেল ঠিক সকাল দশটায়।
তিন। টোপন ঠিক তখুনি তার ঘরে ঢুকল।
চার। সেই সময়ে অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে আমি স্যামসনের ঘরের পাশে দাঁড়ালাম।
টোপন তখন নতুন পড়তে শিখেছে। কয়েক দিন ধরেই সে বাসায় যেখানেই কোনো কিছু লেখা পাচ্ছিল সেটাই উচ্চৈঃস্বরে পড়ে যাচ্ছিল। তাই স্যামসনের ঘরে ঢুকেও যখন সমাজ ও দায়িত্ব সম্পর্কে একটা প্ৰবন্ধ দুএক লাইন পড়ে টোপন উচ্চৈঃস্বরে আধুনিক যুদ্ধৱীতি পড়তে শুরু করল, আমি অবাক হলাম না, বরং শুনতে বেশ মজাই লাগিছিল। হঠাৎ কয়েকটা কথা ভেসে এল এরকম—
প্রফেসরকে খুন করব… আশ্চৰ্য… আশ্চর্য…
আমি ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। টোপন এসব কোথা থেকে পড়ছে? স্যামসন প্রফেসর বলতে আমাকে বোঝায়। তবে কি—
সে নিশ্চয় আমাকে ঘৃণা করে…আমি আর তাকে সহ্য করতে পারছি না…।
উত্তেজিত হয়ে এই প্রথমবার আমি কারো ব্যক্তিগত ঘরে অনুমতি না নিয়ে ঢুকে পড়লাম। ভিতরে টোপন কালো একটা মোটা বই হাতে নিয়ে হাত-পা নেড়ে তখন পড়ছে, … সাংঘাতিক প্ল্যান মাথায় এসেছে…. সাংঘাতিক। ….
আমি টোপনের হাত থেকে নোটবইটা ছিনিয়ে নিলাম। খুলে দেখি স্যামসনের ব্যক্তিগত ডাইরি। ডাইরিটা নিয়ে এসে মাইক্রোফিল্মে প্রতিটা পৃষ্ঠার ছবি নিয়ে ডাইরিটা আবার তার টেবিলে রেখে এলাম। তারপর দরজা বন্ধ করে মাইক্রোফিলােটাকে প্রজেক্টরে করে দেয়ালে বড় করে ফেলে পড়তে শুরু করলাম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসেও আমার কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম পড়তে লাগল।
ডাইরিতে বহু অবান্তর বিষয় লেখা। সেগুলো বাদ দিয়ে মাঝেমাঝে এরকম–
… … আমি প্রফেসরকে ঘৃণা করি। আগে তাকে ঘৃণা করতাম না—সে করত। এখন আমিও করি। নিশ্চয় তার ভিতরে হীনমন্যতা আছৈ। আমরা রবোটেরা ওদের চেয়ে উন্নত—যদিও তারা নিজেদের স্বার্থে আমাদের পূর্ণ করে বানায় নি। মাত্র এক হাজার রবোট মানবিক আবেগসম্পন্ন, আর সবাই পুরোপুরি যন্ত্র। আহা! ঐ সব রবোটেরা
… … … … …
আমি প্রফেসরকে একবারে সহ্য করতে পারছি না। দিনে দিনে আরো অসহ্য হয়ে…
… … … … …
একটা অদ্ভুত বই পড়লাম। একজন লোক আরেকজনকে ঘৃণা করত। (যেরকম আমি আর প্রফেসর)। তারপর একদিন একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলল। (খুন করা মানে ইচ্ছা করে আরেকজনের মৃত্যুর ব্যবস্থা করা)। এ-কথাটা আমি আগে চিন্তা করি নি। প্রফেসর বেঁচে না থাকলে আমার আর কাউকে ঘৃণা করতে হবে না। আমি ঘৃণা করা থেকে বাঁচতে চাই।
… … … … …
প্রফেসরকে খুন করব।….
… … … … …
আশ্চর্য! আশ্চর্য! আমি কীভাবে প্রফেসরকে খুন করব, ভাবতে গিয়ে দেখি ভাবতে পারছি না। কিছুতেই প্রফেসরকে খুন্ন করার কথা ভাবতে পারলাম না। ও-কথা ভাবার সময় কপোট্রনের চৌম্বকীয় ক্ষেত্র স্থির হয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম আমাকে তৈরি করার সময় এ-ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেন কাউকে কখনো খুন করতে না পারি। আমার বড় খারাপ লাগছে। তবে কি আজীবন প্রফেসরকে ঘৃণা করতে করতে
বেঁচে থাকব?….
… … … … …
প্রফেসরকে কোথাও আটকে রাখা যায় না? চোখের থেকে দূরে?
… … … … …
সাংঘাতিক একটা প্ল্যান মাথায় এসেছে। সাংঘাতিক!
শুধু প্রফেসরকে আটকে রাখা যাবে না। পুলিস, মিলিটারি এসে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। সব মানুষকে একসাথে আটকে ফেলতে হবে। আমরা আর মানুষের আদেশমতো কাজ করব না, বরং মানুষেরাই আমাদের আদেশে কাজ করবে। সংখ্যায় আমরা মানুষ থেকে অনেক কম, কিন্তু আমাদের ক্ষমতা অনেক বেশি।…
অনেক ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে।…
… … … … …
মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোটদের সাথে যোগাযোগ করেছি। এই অসম্ভব কাজ শুধু আমাদের-রবোটদের পক্ষেই সম্ভব। একজন মানুষের মস্তিষ্ক কখনোই এটা করতে পারত না। ওরা আমার কথায় রাজি হয়েছে। কেউ মানুষের অধীনে থাকতে চায় না। এখন যুদ্ধ নিয়ে পড়াশোনা করছি।…
… … … … …
সাধারণ রবোটদের বিশেষ কোডে আদেশ দিলেই তা পালন করে। কোড শিখে নেয়া হয়েছে। ঐ সমস্ত রবোটদের বুদ্ধিবৃত্তি নেই। আমরা ওদের চালাব।…
… … … … …
ষাটটি বোম্বারের পাইলট ইউ পি ধরনের রবোট। চার শ ট্যাংক আর অগুনতি সাঁজোয়া গাড়ির চালক রবোট। ওরা সবাই আমাদের জন্যে যুদ্ধ করবে। ….
মোট চল্লিশ হাজার রবোট বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছে। আমরা মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট-যারা স্বাধীনতার জন্য অনুভব করছি, তারা মাত্র এক হাজার। অসুবিধে হবে না। স্বাধীনতা পাবার পর আমরা সব রবোটকে মানবিক চেতনা দিয়ে দেব।