মোটামতন পুলিশটা চিৎকার করে সরে গেল, গাড়িটা তখন হঠাৎ থেমে যায় এবং দরজা দুটি আবার ঝপঝপ করে বন্ধ হয়ে গেল। মানিক অবাক হয়ে দেখল গাড়িটা নিঃশব্দে পিছিয়ে যাচ্ছে, দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে সেটা আবার পুলিশগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। হলোও তাই হঠাৎ করে গাড়িটা পুলিশ তিনজনের দিকে ছুটে এল আর পুলিশ তিনজন “ও বাবাগো ও মাগো” বলে চিৎকার করে ছুটতে থাকে। মোটামতন পুলিশটা রাস্তায় আছাড় খেয়ে পড়ল আর গাড়িটা কাছাকাছি গিয়ে পিছনের দুই চাকার উপর ভর করে সামনের দুই চাকা উপরে তুলে দাঁড়িয়ে গেল।
মোটা পুলিশটা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কোনোমতে সরে যায়, গাড়িটাও ঝপাং করে চাকা নামিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আবার নিঃশব্দে পিছনে সরতে থাকে। দেখেই বোঝা যায় গাড়িটা আবার পুলিশ তিনজনকে আক্রমণ করার পাঁয়তারা করছে। পুলিশ তিনজন এবারে একজন আরেকজনের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকায়। তারপর একজন আরেকজনকে ধরে আতঙ্কিত মুখে তাকিয়ে থাকে। মানিক অবাক হয়ে দেখল, গাড়িটা কেমন জানি একবার গা-ঝাড়া দিল, তারপর একবার পিছনের চাকা দুটো উপরে তুলে ছোটো একটা লাফ দিল। তারপর সামনের চাকা দুটো উপরে তুলে পুলিশগুলোকে ধাওয়া করল। পুলিশ তিনজন চিৎকার করতে করতে ছুটতে থাকে, মানিক আর রতন দেখতে পেল তারা রাস্তা থেকে লাফিয়ে পাশের খেতে নেমে পড়ে তারপর ছুটতে ছুটতে ঝপাং ঝপাং করে একটা ডোবায় লাফিয়ে পড়ল।
ঠিক তখন বহুদূর থেকে একটা সাইরেনের শব্দ শোনা যায়। মানিক আর রতন তাকিয়ে দূর থেকে পুলিশের গাড়ির লাল নীল বাতি জ্বলতে আর নিভতে নিভতে এগিয়ে আসতে দেখতে পায়।
রতন মানিকের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন গাড়িটাকে কুংফু মোড থেকে নরমাল মোডে নিয়ে যাই। কী বল?”
“হ্যাঁ। নিয়ে যাও।”
মানিক আর রতন যে একজন আরেকজনকে তুমি করে বলতে শুরু করেছে সেটা তারা দুজনের কেউই লক্ষ করল না।
রতন বলল, “গাড়িটাকে কাছাকাছি রাখা ঠিক হবে না। দূরে পাঠিয়ে দিই, সেখানে অপেক্ষা করুক।”
মানিক বলল, “হ্যাঁ, দূরে পাঠিয়ে দাও।”
রতন তার রিমোট কন্ট্রোলের কোথায় যানি চেপে ধরল, সাথে সাথে গাড়িটা গর্জন করে ধোয়া ছেড়ে সামনের দিকে ছুটে যেতে লাগল, কিছুক্ষণের মাঝেই চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
অন্যদিক থেকে তখন পুলিশের গাড়িটা লাল নীল আলো জ্বালাতে জ্বালাতে এবং নিভাতে নিভাতে সাইরেন বাজিয়ে চলে আসতে থাকে। গাড়িটা চলে গেছে দেখে পুলিশ তিনজন ডোবা থেকে উঠে মাঠ ধরে হেঁটে আসতে থাকে। ভিজে চুপচুপে, সারা শরীরে কাদা। মোটা পুলিশটার মাথায় কিছু কচুরিপানা, কালো পুলিশের গলায় একটা জোঁক।
পুলিশের গাড়িটার দিকে চোখ রেখে রতন মানিককে জিজ্ঞেস করল, “এখানে কী হয়েছে তুমি কি সেটা সম্পর্কে কিছু জানো?”
মানিক মাথা নাড়ল, বলল, “জানি না।“
“কুংফু গাড়ি?”
“কুংফু গাড়ি? সেটা আবার কী? আমি কিছু জানি না।”
রতন মানিকের দিকে চোখ টিপে বলল, “আমিও জানি না!”
ঠিক এ রকম সময় তাদের সামনে একটা পুলিশের গাড়ি থামে–সেখান থেকে একজন পুলিশ অফিসার নেমে এদিক সেদিক তাকিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসে। তাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, “আমার পুলিশ ফোর্স কই?”
মানিক খোলা হাতটি দিয়ে মাঠের দিকে দেখাল, বলল, “ঐ যে আসছে।” পুলিশ অফিসার সেদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল, মাটি কাদা মেখে ভিজে জবুথবু হয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে তিনজন আসছে। পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে বললেন, “এ কী অবস্থা তোমাদের? কী হয়েছে?”
কালোমতন পুলিশটা বলল, “আপনি বিশ্বাস করবেন না স্যার। গাড়িটা নিজে থেকে আমাদের ধাওয়া করল–”
“কে তোমাদের ধাওয়া করল?”
“গাড়ি স্যার।”
“গাড়িতে কে ছিল?”
“কেউ না স্যার। খালি গাড়ি।”
পুলিশ অফিসার ভুরু কুঁচকে তাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে রইল,
তারপর মেঘস্বরে বলল, “ঠিক করে বল কী হয়েছে?”
“সত্যি কথা বলছি স্যার। খোদার কসম–“
পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বলল, “খবরদার, মুখে আল্লাহ খোদার নাম নিবে না। কী হয়েছে বল।”
“সত্যি কথা বলছি স্যার। আমার কথা বিশ্বাস না হলে ওদের জিজ্ঞেস করেন।”
মোটা পুলিশ হড়বড় করে বলল, “সত্যি কথা স্যার। পুরোপুরি সত্যি। গাড়িটা এসে দরজাটা খুলে ওরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে আমার দিকে ছুটে আসতে শুরু করল। কাছে এসে পিছনের দুই পায়ের উপর দাঁড়িয়ে সামনের দুই পা–”
“পা? গাড়ির পা ছিল?”
“মানে চাকা স্যার। এমনভাবে দাঁড়িয়েছিল যে মনে হলো চাকা না পায়ের ওপর দাঁড়িয়েছে। আরেকটু হলে জানে মেরে ফেলেছিল, কোনোমতে পালিয়ে রক্ষা পেয়েছি।”
“সেই গাড়ি কোথায়?”
“নিজে নিজে চলে গেল।”
“নিজে নিজে চলে গেল মানে?” পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বলল, “গাড়ি নিজে নিজে চলে যায় শুনেছ কখনন? শুনেছ?”
“কিন্তু স্যার গিয়েছে। ওদের জিজ্ঞেস করেন।”
শুকনো পুলিশটা বলল, “জি স্যার গিয়েছে। সত্যি কথা স্যার।”
“তুমি বলবে আর আমি বিশ্বাস করব?”
মানিক একটু গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, “আমি বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করি?”
“আপনি?”
“জি, আমি। এই তিনজন আমাদের দুইজনকে ধরে ব্যাংক ডাকাতির মামলা দেবেন বলে হুমকি দিচ্ছেন।”
“এবং টর্চার করবে–” রতন মনে করিয়ে দিল।