রতন হাত দিয়ে ড্যাশবোর্ডের একটা মনিটর দেখিয়ে বলল, “এই দেখেন আপনার ইসিজি। পরিষ্কার সিগন্যাল। আপনার লোহার মতো শক্ত হার্ট।”
“আ-আ-আমার ইসিজি?”
“হ্যাঁ। সিট বেল্টের সাথে অনেক মনিটর লাগানো আছে। আপনার হার্ট পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।”
মানিক বলল, “ঠিক আছে। হার্ট এটাক না হলে নাই–আপনি আমাকে নামিয়ে দিন। আমি এই গাড়িতে থাকব না। এক সেকেন্ডও থাকব না।”
“কেন?”
“কেন? এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয়? আপনি বুঝতে পারছেন না কেন? প্লিজ গাড়ি থামিয়ে আমাকে নামিয়ে দিন। প্লিজ! প্লিজ!”
রতন মাথা চুলকাল, বলল, “আপনাকে নামিয়ে দিতাম কিন্তু আমর ড্রাইভিং সফটওয়্যারে ছোটো একটা বাগ রয়ে গেছে, এখনো ঠিক করা হয়নি!”
“বাঘ? সফটওয়ারে বাঘ?”
“বাঘ না, বাঘ না, বাগ। সফটওয়ারের সমস্যাকে বলে বাগ!”
আপনার সফটওয়্যারে সমস্যা আছে সেই সমস্যাওয়ালা সফটওয়ার দিয়ে আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন? থামান গাড়ি এখনই থামেন।”
“সেটাই তো সমস্যা।”
“মানে?”
“গাড়ি তো থামাতে পারি না।”
মানিক আর্তনাদ করে বলল, “গাড়ি থামাতে পারেন না?”
“উঁহু।”
“তাহলে? বাকি সারাজীবন এই গাড়িতে থাকতে হবে?”
রতন হাসল, বলল, “না, না! বাকি জীবন কেন থাকতে হবে। আমি গন্তব্য লোড করে দিয়েছি, গন্তব্যে পৌঁছে গেলে নিজে থেকে থেমে যাবে।”
“গন্তব্যে কখন পৌঁছাব?”
“এই তো ঘণ্টাখানেকের মাঝে।“
“ঘণ্টাখানেক? ঘণ্টাখানেক?” মানিক হাহাকার করে বলল, “আমি তার আগেই মরে যাব। নির্ঘাত মরে যাব। আর যদি মারা না যাই তাহলে পাগল হয়ে যাব। উন্মাদ হয়ে যাব। স্মৃতি বিভ্রম হয়ে যাবে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হবে।”
“কিছুই হবে না।”
“হবে। আমি জানি।” মানিক আর্তনাদ করে বলল, “হবে। আজকেই হবে। এক্ষুনি হবে।”
রতন কিছুক্ষণ মানিকের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি সত্যিই নেমে যেতে চান?”
মানিক দ্রুত মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। হ্যাঁ।”
“একটা উপায় আছে।”
মানিক চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “কী উপায়?”
“আমি দরজাটা খুলে গাড়ির হুডের উপর উঠে হুডটা খুলে ব্যাটারির কানেকশানটা যদি খুলে দেই–”
“গাড়ি চলন্ত অবস্থায়?”
“হ্যাঁ। চলন্ত অবস্থায়। সেটা কোনো সমস্যা না। আমার গাড়ির সামনে দুইটা ক্যামেরা তিনটা ছোটো রাডার আছে। দুইটা ইনফ্রারেড লাইটের সোর্স আর ডিটেক্টর সেইসব সিগন্যাল দিয়ে এই গাড়ি পৃথিবীর যে কোনো ড্রাইভার থেকে ভালো গাড়ি চালায়। কাজেই আমি দরজা খুলে হুডের উপর উঠে গেলে কোনো সমস্যা নেই।”
“রাস্তার মানুষজন যখন দেখবে গাড়ির ড্রাইভার হুডের ওপর বসে। আছে তখন কী হবে?”
“কী হবে?”
রতন জিজ্ঞেস করল, “দেখলে কী হবে?”
“তারা অবাক হবে না?”
রতন বলল, “মনে হয় না। এই দেশের মানুষ কোনো কিছুতে অবাক হয় না।” রতন গাড়ির দরজা খুলে বের হওয়ার চেষ্টা করতেই মানিক খপ করে তাকে ধরে ফেলল। রতন জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
মানিক কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, “আর কোনো উপায় নেই?”
রতন মাথা চুলকে বলল, “আরেকটা উপায় আছে।”
“সেটা কী?”
“যদি আপনি খুব জোরে চিৎকার করেন তাহলে গাড়িটা থেমে যেতে পারে।”
“চিৎকার করলে?”
“হ্যাঁ। তখন সিকিউরিটি সিস্টেম মনে করবে একটা ইমার্জেন্সি হয়েছে। আর সেইজন্যে গাড়িটা থামাবে।”
“কী বলে চিৎকার করতে হবে?”
রতন বলল, “যা ইচ্ছে বলতে পারেন!”
“যা ইচ্ছে?”
“হ্যাঁ।”
“বাবাগো মাগো বলতে পারি? বাঁচাও বাঁচাও?”
“যা ইচ্ছে। চেষ্টা করেন।”
মানিক তখন “বাবাগো মাগো, মেরে ফেলল গো, বাঁচাও বাঁচাও” বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে শুরু করল। রতন মাথা নাড়ল, বলল, “হচ্ছে। হচ্ছে। সিস্টেম পিক আপ করছে। আরেকটু জোরে।”
মানিক তখন আরো জোরে জোরে গগনবিদারী চিৎকার করল, “ও বাবাগো ও মাগো! বাঁচাও আমাকে বাঁচাও। আমাকে মেরে ফেলল গো আমার কী হবে গো! আমার কী সর্বনাশ হলো গো! বাঁচাও বাঁচাও।”
আর গাড়িটা ঠিক তখন থেমে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। রতন বলল, “আপনি এখন থামতে পারেন।”
মানিক কোনো ঝুঁকি নিল না, আরো জোরে চিৎকার করতে লাগল, “ও বাবাগো! ও মাগো! মেরে ফেললো গো!”
রতন বলল, “থামেন থামেন! এখন চিৎকার করলে বিপদ হয়ে যাবে।”
মানিক থামল, কিন্তু ততক্ষণে বিপদ হয়ে গেছে। গাড়ি যেখানে থেমেছে ঠিক সেইখানে কিছু পুলিশ দাঁড়িয়েছিল। তারা দৌড়ে এসে গাড়িটা ঘিরে ফেলল। একজন রাইফেল তুলে বলল, “হ্যান্ডস আপ। হাত তুলে গাড়ি থেকে নেমে আস। একটু তেড়িবেড়ি করলেই গুল্লি। সোজা ক্রসফায়ার।”
রতন বলল, “কেন? কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে মানে? কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছ–পরিষ্কার চিৎকার শুনেছি আমরা।”
“আসলে সেটা সত্যি সত্যি চিৎকার না–এমনি এমনি”
কালোমতন একজন পুলিশ চিৎকার করে বলল, “আবার কথা বলে? কতো বড়ো সাহস? নাম গাড়ি থেকে।”
মোটামতন একজন পুলিশ বলল, “এত কথার দরকার কী? মাথার মাঝে গুলি করে দাও। সোজা ক্রসফায়ার।”
শুকনোমতন একজন পুলিশ বলল, “কলার ধরে নামাও। নামিয়ে প্রথমে আচ্ছা মতো বানাও।”
মানিক আর রতন বুঝতে পারল অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এখন গাড়ি থেকে নেমে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। দুইজন তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নামল। তখন পুলিশ তাদের টেনে গাড়ির পাশে দাঁড় করিয়ে দিল। পিঠের মাঝে রাইফেল ঠেকিয়ে কালোমতন পুলিশ হুংকার দিয়ে বলল, “তোরা কারা? ডাকাত, সন্ত্রাসী নাকি কিডন্যাপার?”