রতন তখন তার হাত মেলে তার নখের নীচে দেখল, কিছু বলল না।
মানিক বলল, “বৈজ্ঞানিকদের বিয়ে হয় না। কোনো মেয়ে বৈজ্ঞানিকদের বিয়ে করতে রাজি হয় না। যদি বা বিয়ে করে, সেই বিয়ে বেশিদিন টেকে না–ডিভোর্স হয়ে যায়।”
রতন দুর্বল গলায় বলল, “আ-আপনি কীভাবে জানেন?”
“না জানার কী আছে? সবাই জানে। আমার কথা বিশ্বাস না করলে একটা বৈজ্ঞানিক খুঁজে বের করেন।”
রতন নিশ্বাস ফেলে বলল, “খুঁজে বের করতে হবে না।”
“কেন?”
“আমি নিজেই একজন বৈজ্ঞানিক।”
মানিক থতমত খেয়ে বলল, “আ-আপনি বৈজ্ঞানিক?”
“হ্যাঁ। ছোটোখাটো একজন পাতি বৈজ্ঞানিক।”
“আপনি কী কী আবিষ্কার করেছেন?”
রতন বলল, “ছোটোখাটো জিনিসপত্র। যেমন এই হাতঘড়িটা আসলে একই সাথে হাতঘড়ি আর ব্লাডপ্রেশার মাপার যন্ত্র। আমার শার্টটা সোলার সেল, এই যে রোদে দাঁড়িয়ে আছি ব্যাটারি চার্জ হচ্ছে।”
রতন চশমাটা। দেখিয়ে বলল, “এই চশমাটা একইসাথে চশমা আর কম্পিউটার মনিটর। আর এই যে আংটিটা দেখছেন, এটা আসলে আংটি না, কম্পিউটারের মাউস।”
মানিক ঢোক গিলে বলল, “ক-কম্পিউটার কোথায়?”
“ছোটোগুলো শার্টের কলারে। বড়োগুলো গাড়িতে।”
“বড়োগুলো মানে? কয়টা কম্পিউটার গাড়িতে?”
“প্রত্যেকটা চাকার জন্যে একটা, স্টিয়ারিং হুইলে একটা, কন্ট্রোলের জন্যে একটা।”
মানিক চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “এই গাড়ি কোথায় পেলেন?”
“কোথায় পাব? আমার কি গাড়ি কেনার পয়সা আছে?”
“তাহলে?”
“বানিয়ে নিয়েছি।”
“গা-গা-গাড়ি বানিয়েছেন?”
“হ্যাঁ। বেশি ভালো হয় নাই কিন্তু কাজ করে।”
মানিক গাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, “শব্দ মনে হয় একটু বেশি করে কিন্তু শব্দই যদি না করল তাহলে কীসের গাড়ি?”
রতন মাথা নাড়ল, বলল, “আসলে এই গাড়ি কোনো শব্দ করে না। ইলেকট্রিক গাড়ি তো শব্দ নাই। কিন্তু শব্দ না থাকলে মানুষজন সন্দেহ করে–তাই শব্দের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। শব্দ আর ধোঁয়া।”
“ধোঁয়াটাও বানানো?”
“হ্যাঁ।”
“কী আশ্চর্য!” মানিক এবারে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে রতনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আপনাকে দেখে বৈজ্ঞানিকদের সম্পর্কে আমার ধারণাই পালটে গেল। আমি আরো ভাবতাম বৈজ্ঞানিকেরা খালি কাগজে লম্বা লম্বা সমীকরণ লিখে। আপনি তো দেখি অসাধারণ!”
রতন দুর্বলভাবে মাথা নেড়ে বলল, “আরে না! অসাধারণ হলো কীভাবে? যদি আবিষ্কার করতাম ই ইকুয়েল টু এম সি স্কয়ারের মতো এক সূত্র তাহলে বলতেন অসাধারণ।
মানিক ভুরু কুঁচকে বলল, “ই ইকুয়েল টু কী?”
“এম সি স্কয়ার।“
“আবিষ্কার হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ। আইনস্টাইন আবিষ্কার করেছেন।
“তাতে কী হয়েছে! সি শেষ হয়েছে তো কী হয়েছে, ডি তো আছে আপনি আবিষ্কার করবেন ই ইকুয়েল টু এম ডি স্কয়ার!”
রতন খানিকক্ষণ মানিকের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটা বড়ো নিশ্বাস ফেলল। মনে মনে ভাবল, ভাগ্যিস আইনস্টাইন এই কথাগুলো শোনার জন্যে বেঁচে নেই।
মানিক অবশ্যি এতকিছু খেয়াল করল না, সত্যিকারের একজন বৈজ্ঞানিককে দেখে সে মহাখুশি। হাত পা নেড়ে বলল, “আপনি একটু আগে চিউইংগাম খেতে চেয়েছিলেন না? চলেন ঐ দোকানে। যাই–চিউইংগাম না থাকলেও লজেন্স চকলেট কিছু-একটা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।”
রতন বলল, “না, না– আমি খাওয়ার জন্যে চিউইংগাম খুঁজছি না।”
“তাহলে?”
“লুব্রিকেশানের ট্যাঙ্কটা লিক করছে। একটা চিউইংগাম থাকলে চিবিয়ে নরম করে টিপে লাগিয়ে দিলে লিকটা বন্ধ হয়ে যেত।”
মানিক মুখ হা করে বলল, “অ! আর এক টাকার কয়েন?”
“ব্যাটারির কন্টাক্টটা ক্ষয়ে গেছে। কয়েনটা ঢুকিয়ে স্কু টাইট দিলেই কাজ কমপ্লিট।”
মানিক বলল, “আপনি চিন্তা করবেন না, আমি ঐ দোকান থেকে চিউইংগাম কয়েন সব জোগাড় করে দেব।”
“থ্যাংকু।”
“আসেন আমার সাথে।”
দোকানে চিউইংগাম পাওয়া গেল না কিন্তু রতন চুনের সাথে চিনি মিশিয়ে বিচিত্র এক ধরনের আঠা তৈরি করে তার লুব্রিকেন্ট ট্যাঙ্কের লিক সারিয়ে ফেলল। দোকান থেকে কয়েন ভাঙিয়ে নিয়ে ব্যাটারির কানেকশান লাগিয়ে রতন সেটাও ঠিক করে ফেলল। রতন তার গাড়িতে উঠতে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি কোথায় যাবেন?”
“শ্রীমঙ্গল।”
“আমিও ঐ রাস্তাতেই যাচ্ছি, আপনাকে আমি আমার গাড়িতে তুলে নিতে পারতাম। কিন্তু “ রতন কথা শেষ না করে থেমে গেল।
“কিন্তু কী?”
“আমার মনে হয় সেটা ঠিক হবে না।”
“কেন?”
“আপনি ভয় পাবেন। এর আগে যাকে তুলেছিলাম তার একটা ছোটো হার্ট এটাকের মতো হয়েছিল।”
“কেন?”
“আমি যেভাবে গাড়ি চালাই সেটা সবাই সহ্য করতে পারে না।”
“কীভাবে গাড়ি চালান?”
“ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। নিজের চোখে দেখলে হয়ত একটু অনুমান করা যায়।”
মানিক বলল, “আমাকে দেখান।”
রতন বলল, “ভয় পাবেন না তো?”
“না পাব না।”
“হার্ট এটাক হবে না তো?”
“না। আমার হৃদয় হচ্ছে কবির হৃদয়। কবির হৃদয় কখনো কাউকে হতাশ করে না। সেটি ফুলের মতো কোমল আবার পাথরের মতো শক্ত।”
“ঠিক আছে, তাহলে ওঠেন।” রতন মানিকের জন্যে দরজা খুলে দিল, বলল, “ভয় পেলে পরে আমাকে দোষ দেবেন না।”
মানিক গাড়ি উঠেই বুঝতে পারল এটা অন্যরকম গাড়ি। ভেতরে নানারকম বিচিত্র যন্ত্রপাতি। ড্যাশবোর্ডে ছোটো ছোটো অনেকগুলো মনিটর। নানারকম সুইচ, নানারকম লিভার। রতন একটা সুইচ টিপে দিতেই বিকট শব্দ করতে শুরু করল, আরেকটা সুইচ টিপে দিতেই পিছন দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হতে থাকে। রতন সন্তুষ্টির মতো ভঙ্গি করে বলল,