“ঘরে বোঁটকা একটা গন্ধ হয়।”
কালা কবি তখন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, কাছে দাঁড়িয়ে থেকে খানিকক্ষণ চেয়ারের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর আবার সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে মুখ বিকৃত করে খকখক করে কেশে উঠল। বলল, “এ কী? এত মজার সিগারেটটার এই অবস্থা কেন? সিগারেট তো না মনে হচ্ছে। ট্রাকের মবিল পোড়া ধোঁয়া।”
মানিক এবারে মুখ শক্ত করে বলল, “ঘরের ভেতরে না। বাইরে।”
কালা কবিও তার মুখ শক্ত করে বলল, “দাঁড়াও। আমাকে ব্যাপারটা আগে বুঝতে দাও। এই চেয়ারে বসে সিগারেট খেলে মনে হয় বেহেশতি সিগারেট আর চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেই মনে হয় মবিল পোড়া ধোয়া–ব্যাপারটা কী?”
মানিক বলল, “কোনো ব্যাপার নেই। রাত হয়েছে, তুমি এখন বাসায় যাও। আমার কাজ আছে।”
শুধু কথা বলেই মানিক শান্ত হলো না, সে সারাজীবন যে কাজটা করেনি সেই কাজটা করে ফেলল, কালা কবিকে সে ঠেলে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করল।
কালা কবি মোটেই বের হতে রাজি হলো না, সিগারেটটা হাতে নিয়ে প্রায় জোর করে আবার চেয়ারটাতে বসে গেল, তারপর সিগারেটে লম্বা আরেকটা টান দিয়ে আনন্দের একটা শব্দ করল, “আ হ হ হ হ হ হ…!”
মানিক বুঝতে পারল সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। কালা কবি এই চেয়ারটা সম্পর্কে জেনে গেছে। ঠিক তাই হলো, সে ঢুলুঢুলু চোখে মানিকের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন আমি বুঝতে পারছি তুমি কেন এই চেয়ার নিয়ে সত্যি কথাটা কাউকে বলো না!”
মানিক কোনো কথা বলল না। কালা কবি বলল, “এই চেয়ারে বসে সিগারেট টানতেই এত আনন্দ, একটা রসগোল্লা খেলে না জানি কত আনন্দ হবে। মানিক ভাই, দাও না একটা রসগোল্লা!”
মানিক বলল, “রসগোল্লা নেই।”
“তাহলে কী আছে?”
“কিছু নেই।”
“কিছু নাই? ভাত, রুটি, ডিম?”
“না। কিছু নেই।”
“কিছু নাই?” কালা কবি একটু ব্যস্ত হয়ে বলল, “তাহলে ঐ খবরের কাগজটা দাও না।”
“কেন?”
“খেয়ে দেখব কেমন লাগে।”
“খবরের কাগজ? তুমি খবরের কাগজ খাবে?” কা
লা কবি ঢুলুঢুলু চোখে বলল, “কেন? খেলে সমস্যা আছে?”
মানিক কোনো কথা বলল না, মুখ শক্ত করে খবরের কাগজটা কালা কবির হাতে ধরিয়ে দিল। কালা কবি প্রথমে খেলাধুলার পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে খেয়ে ফেলল। মানিক দেখল কালা কবির চোখে-মুখে আনন্দ। সে যত তৃপ্তি দিয়ে খবরের কাগজটা খেলো কোনো মানুষ এত তৃপ্তি করে কখনো রসমালাই কিংবা গুড়ের সন্দেশ খায়নি। খেলাধুলার পৃষ্ঠা শেষ করে সম্পাদকীয় পাতা, তারপর আন্তর্জাতিক খবর, সবার শেষে পত্রিকার হেডলাইন সে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলল। শুধু যে খেলো তা নয়, প্রতি এক মিনিট পর পর আহা উঁহু করে তৃপ্তির শব্দ করতে লাগল।
মানিক বলল, “খবরের কাগজ খেয়ে ফেলাটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না।”
সিনেমার পৃষ্ঠাটা চিবুতে চিবুতে কালা কবি বলল, “কেন? ভালো হচ্ছে না কেন?”
“খবরের কাগজ কেউ খায় না। এটা খাওয়ার জিনিস না। এটা তোমার হজম হবে না। তোমার পেটের সমস্যা হবে।”
কালা কবি বলল, “যে জিনিস খেতে এত মজা সেটা হজম হবে না কেন? একশবার হজম হবে।”
মানিক কী করবে বুঝতে না পেরে হতাশ হয়ে সোফায় বসে কালা কবির দিকে তাকিয়ে রইল।
কালা কবি খবরের কাগজ পুরোটা খেয়ে শেষ করে শেলফ থেকে সাতশ পৃষ্ঠার সঞ্চয়িতাটা নিয়ে খাওয়া শুরু করল। মানিক অনেক কষ্ট করেও তাকে থামাতে পারল না।
কালা কবি অবশ্যি পুরো সঞ্চয়িতাটা খেয়ে শেষ করতে পারল না, শেষ একশ পৃষ্ঠা বাকি থাকতেই এম্বুলেন্স ডেকে কালা কবিকে হাসপাতালে নিতে হলো। ইমার্জেন্সিতে একজন ডাক্তার ঘুম ঘুম চোখে বসেছিল কালা
কবিকে দেখে উঠে এল। জানতে চাইল, সমস্যাটা কী? কালা কবি পেট চেপে ধরে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে বলল, “ব্যথা। পেটে ব্যথা!”
“কী হয়েছে। কেন ব্যথা?”
কালা কবি তখন কোনো উত্তর দিল না। মানিক বলল, “আজকের খবর কাগজ আর সঞ্চয়িতার প্রায় পুরোটা খেয়ে ফেলেছে।”
ডাক্তারের ঘুম ঘুম ভাব পুরোপুরি ছুটে গেল, “কী খেয়ে ফেলেছে?”
মানিককে আবার বলতে হলো, “আজকের খবরের কাগজ আর। সঞ্চয়িতার প্রায় পুরোটা।”
ডাক্তার বলল, “খ-খ-খ” মানিক বাক্যটা শেষ করিয়ে দিল, “জি। খবরের কাগজ।”
“আর স-স-স”
“জি, সঞ্চয়িতা। তৃতীয় সংস্করণ। অফসেট কাগজ—“
ডাক্তার কিছুক্ষণ কালা কবির দিকে আর কিছুক্ষণ মানিকের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
মানিক একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, “সেটা বলা সম্ভব না। যদি বলাও হয় বোঝানো সম্ভব না। যদি বোঝানো সম্ভব হয় বিশ্বাস করানো সম্ভব না। যদি বিশ্বাস করানো সম্ভব হয় গ্রহণ করা সম্ভব না। যদি গ্রহণ করানো সম্ভব হয়–“
ডাক্তার এই সময় হাত তুলে মানিককে থামিয়ে দিল।
.
গভীর রাতে দরজায় শব্দ শুনে রতন ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দিল। দেখল মানিক তার চেয়ারটা ঘাড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রতন জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার মানিক, এত রাতে?”
“তোমার চেয়ারটা ফেরত দিতে এসেছি।”
“কেন?”
“কারণটা এই মুহূর্তে বলে শেষ করা সম্ভব না। যদি বলা হয়। বোঝানো সম্ভব না। যদি বোঝানো সম্ভব হয় বিশ্বাস করানো সম্ভব না। যদি বিশ্বাস করানো সম্ভব হয় গ্রহণ করা সম্ভব না। যদি গ্রহণ করা সম্ভব হয়”
রতন হাত তুলে থামিয়ে দিল। বলল, “বুঝেছি। এসো, ভেতরে এসো।”