কালা কবি ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “তোমাদের এইদিকে একটা অনুষ্ঠানে দাওয়াত ছিল। তাই ভাবলাম তোমার বাসাটা দেখে যাই।” কথাটা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম, জেনেশুনে তাকে কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়ার কথা না।
মানিক মুখে জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে রেখে বলল, “এসো, এসো, বসো।”
কালা কবি না বসে ঘরের ভিতরে হেঁটে হেঁটে সবকিছু দেখতে দেখতে তার সেই বিশেষ চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, “এটা কী?”
মানিক কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, “চেয়ার।”
“চেয়ারটা এরকম কেন? এত যন্ত্রপাতি কেন?”
মানিক ইতস্তত করে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “না মানে ইয়ে এটা হচ্ছে গিয়ে মানে যাকে বলে একটা ডাক্তারি চেয়ার। মানে শরীরে সমস্যা থাকলে এখানে বসে, মানে ইয়ে সেই সমস্যাগুলো তখন বোঝা যায়।” মানিক ভালো মিথ্যে কথা বলতে পারে না তাই তার কথাটা খুবই খাপছাড়া শোনাল।
কালা কবি খুবই সন্দেহের চোখে একবার মানিকের দিকে তাকাল তারপর আরেকবার চেয়ারটার দিকে তাকাল, তারপর বলল, “আমার বড়ো দুলাভাইয়ের ডায়াগনস্টিক চেম্বার আছে, আমি সেখানে এইরকম কোনো ডাক্তারি চেয়ার কখনো দেখি নাই।”
মানিক আমতা আমতা করে বলল, “এটা ঠিক বাণিজ্যিক নয়, এটা অনেকটা পরীক্ষামূলক চেয়ার। সেজন্যে মনে হয় কখনো দেখোনি।”
কালা কবি আরো সন্দেহের চোখে তার দিকে তাকাল, তারপর বলল, “তোমার বাসায় পরীক্ষামূলক যন্ত্রপাতি কীভাবে এসেছে? তুমি কবি মানুষ, সবসময় বলে বেড়াও যন্ত্রপাতিতে তোমার এলার্জি–”
মানিক আবার মাথা চুলকাল, সে মিথ্যে কথা বলতে পারে না কিন্তু এখন তাকে মিথ্যা কথাই বলতে হবে, কীভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, “এটা আমার ছোটো খালুর চেয়ার। তার ছেলে বানিয়ে দিয়েছে। খালুর বাসায় রাখার জায়গা নেই তাই এখানে পাঠিয়েছে।”
একটা বাসায় একটা চেয়ার রাখা যায় না এটা খুব বিশ্বাস করার মতো কথা না তাই কালা কবি আরো অনেক বেশি সন্দেহের চোখে মানিকের দিকে তাকিয়ে রইল। মানিক তখন তার কথাটা ঘুরিয়ে অন্যদিকে নেওয়ার জন্যে বলল, “তা তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো।”
বলেই বুঝতে পারল এই কথাটা বলা ঠিক হয়নি। কারণ কালা কবি তখন যে কাজটা করল তার জন্যে মানিক একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। মানিক কিছু বোঝার আগেই কালা কবি হেঁটে হেঁটে গিয়ে তার এই বিশেষ চেয়ারটাতে বসে পড়ে। মানিক অবাক হয়ে দেখল এতক্ষণ কালা কবির চোখে মুখে একটা সন্দেহ, একটা ভ্রুকুটি খেলা করছিল হঠাৎ করে তার বদলে সেখানে আনন্দের একটা ছাপ এসে পড়ল। তার চোখে মুখে আরাম আর তৃপ্তির একটা ঢেউ খেলে যেতে থাকে, মানিক দেখল কালা কবির চোখ আরামে কেমন যেন বন্ধ হয়ে আসছে।
মানিক কী করবে বুঝতে পারল না, সে যন্ত্রপাতি চালাতে পারে না বলে এটা সব সময়েই অন করে রাখা থাকে। এভাবে যে কালা কবি এখানে বসে যাবে সে একেবারেই সন্দেহ করেনি। একজন বড় মানুষ একটা চেয়ারে বসে গেলে তাকে টেনে ওঠানো সম্ভব না, মানিক তাই সে চেষ্টা করল না, বলল, “এখানে বসো না। উঠে আসো তাড়াতাড়ি উঠে। আসো।”
কালা কবি মধুর স্বরে বলল, “কেন ভাই? বসলে কী হয়?”
মানিক বলল, “দেখছ না কত যন্ত্রপাতি–এখান থেকে কতকিছু বের হয়। মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে।”
কালা কবির মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হলো, সে সারা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “মস্তিষ্কের ক্ষতি হলে হোক। আমার কিছু আসবে যাবে না। আমি এখানেই বসব। বসে থাকব।”
মানিক নিজেই লক্ষ করেছে এই চেয়ারে বসলেই একটা আরামের। অনুভূতি হতে থাকে আর খাওয়া শুরু করলে তো কথাই নেই। ভাগ্যিস কালা কবির সামনে কোনো খাবার নেই, যদি কোনো একটা খাবার থাকতো তাহলে কী হতো?
কালা কবি তার ঢুলুঢুলু চোখ খুলে বলল, “কী আরাম! আমার বাপের জন্মে কখনো এত আরাম পাই নাই। কী হয়েছে? আমার এত আরাম লাগে কেন?”
মানিক কী বলবে বুঝতে পারল না, চোখ বড়ো বড়ো করে কালো। কবির দিকে তাকিয়ে রইল। কালা কবি তখন ধীরে ধীরে তার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সেখান থেকে একটা সিগারেট বের করে মুখে লাগিয়ে ফস্ করে একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে সেটা জ্বালিয়ে নিয়ে লম্বা টান দিল। মানিক দেখল সাথে সাথে কালা কবির সমস্ত চেহারা যেন আনন্দে, আরামে, সুখে, তৃপ্তিতে একেবারে একশ ওয়াট বাতির মতো জ্বলে উঠল! মানিকের আর বুঝতে বাকি রইল না এই চেয়ারের গোপন কথাটা এখন কালা কবি টের পেয়ে যাবে। সে শুনল, কালা কবি তার সারা শরীর এলিয়ে দিয়ে গভীর আরামের একটা শব্দ করল, “আ-হ্-হ্-হ্-হ্-হ্…!”
কালা কবি কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে আবার সিগারেটে আগের থেকেও একটা লম্বা টান দিল আর মনে হলো এবারে আনন্দে, আরামে আর তৃপ্তিতে তার সারা শরীর এলিয়ে গেল। সে ঢুলুঢুলু চোখে মানিকের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই সিগারেটে কী আছে বলো তো? একেক টানে মনে হচ্ছে একেবারে স্বর্গে চলে যাচ্ছি! ব্যাপারটা কী?”
মানিক জানে ব্যাপারটা কী, কিন্তু সেটা তো আর কালা কবিকে বলতে পারে না, তাই যেটা বলতে পারে সেটাই বলল, “আমার ঘরে আমি কাউকে সিগারেট খেতে দিই না! তুমি যদি খেতে চাও বাইরে গিয়ে খাও।”
কালা কবির মুখে বিশাল একটা হাসি ফুটে উঠল, বলল, “কেন? ঘরে সিগারেট খেলে কী হয়?”