“বলেছিলে নাকি?”
“হ্যাঁ। বলেছিলাম। আবার বলছি। যেহেতু ব্যাপারটা ঘটে তোমার মস্তিষ্কে তাই কোনো কিছু খেয়ে সেটা ভালো লাগার জন্য আমরা সেটাকে সুস্বাদু করে রান্না না করে মস্তিষ্কে সুস্বাদু লাগার অনুভূতি দিলে একই ব্যাপার ঘটবে।”
মানিক চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “মস্তিষ্কে? মস্তিষ্কে অনুভূতি?”
“হ্যাঁ”
“সেটা তুমি কখন দিয়েছ?”
“আমার চেয়ার।”
“তোমার চেয়ার?”
রতন বলল, “মনে নেই তোমাকে আমি আমার ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে খেতে দিইনি! তোমাকে বাধ্য করেছি আমার স্পেশাল চেয়ারে বসতে?”
“হ্যাঁ। মনে আছে?”
“এই চেয়ারটা বিশেষভাবে তৈরি। মাথার মাঝে হাই ফ্রিকোয়েন্সির ম্যাগনেটিক ফিল্ড দিয়ে মস্তিষ্কের ভেতর ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি করতে পারে?”
মানিক কিছুক্ষণ রতনের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি আমার মস্তিষ্ক অনুরণন করেছ নাকি আসলেই খাবারগুলো স্বর্গীয় ছিল আমি সেটা কোনোদিন জানতে পারব না। কিন্তু আমাকে বলতেই হবে, আজ রাতের খাওয়াটা আমার জন্য ছিল একটা স্বর্গীয় অনুভূতি।”
রতন মাথা নাড়ল, বলল, “আমি জানি। আমি নিজেকে দিয়ে পরীক্ষা করেছি। কিন্তু আমি আরো একজনকে দিয়ে ব্যাপারটা পরীক্ষা করাতে চেয়েছিলাম, তাই আমি তোমাকে ডেকে এনেছি। কাজেই এখন আমি বলতে পারি আমার এক্সপেরিমেন্ট পুরোপুরি কাজ করেছে। আমি এখন জানি কেমন করে ইচ্ছে করলেই একজন মানুষকে মজার মজার খাওয়ার অনুভূতি দেয়া যায়। ভালো করে রান্না করারও দরকার নেই, যা খুশি রাঁধতে পারো, খাওয়ার সময় শুধু মস্তিষ্কে স্বাদের অনুভূতিটা দিতে হবে।”
মানিক কষ্ট করে সোফায় সোজা হয়ে বসে বলল, “তুমি যেভাবেই বলতে চাও বলো, কিন্তু আমি তোমাকে জানাতে চাই আজ রাতের খাবারটা ছিল একটা স্বর্গীয় অনুভূতি।”
রতন হাসল, বলল, “আমি তো কখনো স্বর্গে যাইনি তাই স্বর্গের অনুভূতি কেমন হয় এখনো জানি না।”
একটু পর মানিক জিজ্ঞেস করল, “এখন এই চেয়ারটা দিয়ে তুমি কী করবে?”
রতন বলল, “আমার কাজ শেষ তাই এই চেয়ারের আর কোনো দরকার নাই। যন্ত্রগুলো খুলে অন্য কাজে লাগাব। আমার পরের গবেষণা হবে–”
মানিক তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “কী বললে? এই চেয়ারের আর দরকার নেই?”
“কী বলছ তুমি? তোমার দরকার না থাকলে আমাকে দিয়ে দাও। আমি নিয়ে যাব। আমার বাসায় রাখব।”
রতন হা হা করে হেসে বলল, “তুমি না একটু আগে আমাকে বলেছিলে তুমি যন্ত্রকে ঘৃণা কর! এখন তুমি এই যন্ত্র তোমার বাসায় নিয়ে যাবে?”
মানিক থতমত খেয়ে বলল, “এটা তো যন্ত্র নয়, রতন। এটা হচ্ছে স্বর্গের সাথে যোগাযোগের একটা মাধ্যম।”
রতন বলল, “সব যন্ত্রই এরকম যোগাযোগের কোনো না কোনো মাধ্যম। তুমি হয়ত আগে লক্ষ করনি।”
মানিক বলল, “ঠিক আছে। তাহলে এখন তুমি কি এই চেয়ারটা। আমাকে দেবে?”
“তুমি যদি চাও অবশ্যই দেব! কিন্তু আমি তোমাকে একটা জিনিস বলি। সেটা হচ্ছে স্বাভাবিক কাজ স্বাভাবিকভাবে করতে হয়, সেখানে খামোখা যন্ত্রকে হাজির করতে হয় না! যদি ভালো খেতে চাও ভালো রান্না করা শিখে নাও, যন্ত্র দিয়ে মস্তিষ্কে স্টিমুলেশন দিও না।”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে।” মানিক হাত তুলে রতনকে শান্ত করে। বলল, “মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যন্ত্রের ভূমিকা এটা নিয়ে একটা গোল টেবিল বৈঠক করা যাবে। আপাতত তুমি আমাকে এই চেয়ারটা দাও।”
“অবশ্যই দিব। কিন্তু একটা শর্ত।”
“কী শর্ত?”
“তুমি এই চেয়ার দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পার। কিন্তু অন্য কোনো মানুষকে এই চেয়ারের কথা বলতে পারবে না।”
“বলব না। আমি জানি তুমি কখনো কোনো সাংবাদিককে তোমার গবেষণার কথা বল না। বলতে চাও না।”
কাজেই সেদিন রাত্রিবেলা মানিক এই বিশেষ চেয়ারটা ঘাড়ে করে তার বাসায় নিয়ে গেল।
.
এরপর থেকে মানিকের দিনগুলো সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে গেল। এমনিতে সে খাওয়া পছন্দ করে এখন খাওয়ার ব্যাপারটা তার জীবনের একমাত্র ব্যাপার হয়ে গেল। সকালে নাস্তা করতে বসে সে খেতেই থাকে। খাওয়ার সময় সেটা টের পায় না পরে বেশি খাওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকে। আগে কখনোই দুপুরে খাওয়ার জন্যে বাসায় আসত না এখন যত ঝামেলাই থাকুক সে দুপুরে খাওয়ার জন্য বাসায় ফিরে আসে। তার বাসার কাজকর্মে সাহায্য করার মহিলা ময়নার মা যেটাই বেঁধে রাখে সে খেয়ে শেষ করে ফেলে! রাত্রে বেলায় তো কথাই নেই, রান্না করা খাবার থাকলে ভালো, না থাকলেও সমস্যা নেই ফ্রিজে যা আছে মানিক কপকপ করে খেতে থাকে। এভাবে খেতে থাকলে মানিকের কয়েকদিনের মাঝে হাতির মতো মোটা হয়ে যাবার কথা। তার শরীর এত অল্প সময়ে এত খাবার সহ্য করতে পারবে কি না সেটাও একটা বিশাল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল। খাবার খেতে কোনো সমস্যা হয় না, কিন্তু হজম করতে গিয়ে তার শরীর কাহিল। হতে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত কী হতো কেউ বলতে পারে না কিন্তু তার মাঝে হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ায় পুরো ব্যাপারটা অন্য রকম হয়ে গেল।
.
মানিক সেদিন রাতের খাবার খেয়ে সোফায় বসে একটা বই পড়ছে, ফ্রিজে খাবার নেই বলে আজকে বেশি খেতে পারেনি, তাই ভেতরে একটু অতৃপ্তির ভাব। ঠিক এরকম সময়ে তার দরজায় শব্দ হলো। দরজা খুলতেই দেখে সেখানে কালা কবি দাঁড়িয়ে আছে। কালা কবির নাম কেন কালা কবি সেটা কেউ জানে না, কারণ সে কালো না এবং কবিও না। তার গায়ের রং যথেষ্ট ফর্সা এবং সে যদিও কবি সাহিত্যিকদের জগতে ঘুরোঘুরি করে, তার। চেহারা এবং ভাবভঙ্গি কবিদের মতো কিন্তু সে নিজে কোনোদিন একটা লাইন কবিতাও লিখেনি। মানুষটা ধুরন্ধর, মতলববাজ এবং অসৎ, তাকে। দেখলেই সবার মুখ কালো হয়ে যায় সেজন্য হয়ত তার নাম কালা কবি। তবে শব্দটা কালো না হয়ে কেন কালা তারও ভালো ব্যাখ্যা নেই। দরজায় কালা কবিকে দেখে মানিকের মুখটা একটু কালো হয়ে গেল, সে তারপরও যতটুকু সম্ভব স্বাভাবিক থাকার ভান করে বলল, “আরে! তুমি! কী মনে করে? এসো।”