মানিক তবুও সন্দেহের চোখে এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। রতন বলল, “এই দেখো, আমি এই চেয়ারে বসছি।” বলে রতন চেয়ারটিতে বসে বলল, “আমার কিছু হয়েছে? হয়নি।” সে আবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি এইভাবে একবার বসে দেখো।”
মানিক বলল, “ঠিক আছে। তোমাকে বিশ্বাস করে আমি এই একবার বসছি। কিন্তু জেনে রাখো এই প্রথম এবং এই শেষ।”
“ঠিক আছে।”
“আমি যন্ত্রকে ঘৃণা করি। শুধুমাত্র তোমার কারণে এরকম বিদঘুঁটে একটা যন্ত্রের কাছাকাছি আমি বসতে যাচ্ছি।”
“ঠিক আছে।”
“আমি ঘড়ি ধরে ঠিক এক মিনিট এই চেয়ারে বসে থাকব। তারপর উঠে যাব।”
“ঠিক আছে।”
মানিক তখন গিয়ে চেয়ারটিতে বসল, তার চোখে মুখে তখন খানিকটা বিরক্তি, খানিকটা ক্রোধ, খানিকটা যন্ত্রণা, খানিকটা তাচ্ছিল্য এবং খানিকটা অস্থিরতা। কিন্তু চেয়ারে বসার সাথে সাথে তার চোখে মুখে একটা বিচিত্র পরিবর্তন দেখা গেল। বিরক্তি, ক্রোধ যন্ত্রণা তাচ্ছিল্য অস্থিরতা সবকিছু সরে গিয়ে সেখানে এক ধরনের বিস্ময় আর আনন্দের ছাপা পড়ল। সে বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, “অপূর্ব!”
রতন জিজ্ঞেস করল, “কী অপূর্ব?”
“তোমার রান্না। খাবারের এত সুন্দর ঘ্রাণ আমি জীবনে কখনো পাইনি! মনে হচ্ছে একেবারে স্বর্গীয়। আহা হা হা!”
রতন বলল, “তুমি বলেছ ঠিক এক মিনিট পর এই চেয়ার থেকে উঠে পড়বে। এক মিনিট শেষ হবার খুব বেশি দেরি নেই। তুমি ইচ্ছে করলে এখন উঠে পড়তে পার।”
মানিকের মুখে কেমন জানি বিহ্বল একটা হাসি ফুটে উঠল। বলল, “না রতন। আমার ওঠার কোনো দরকার নেই। খাবারের এই অপূর্ব ঘ্রাণে আমার জিবে পানি চলে এসেছে। আগে আমি খাব।”
রতন হাসি গোপন করে বলল, “ঠিক আছে।” তখন সে মানিকের সামনে আরেকটা চেয়ারে বসে পড়ল। মানিক খুব আগ্রহ নিয়ে তার প্লেটে কয়েক চামচ কড়কড়ে ভাত নিয়ে সেগুলোর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর পুরো প্লেটটা হাত দিয়ে নাকের কাছে এনে একটু ঘ্রাণ নিয়ে বলল, “আ হা-হা-হা! কী অপূর্ব ঘ্রাণ!”
তারপর হাত দিয়ে কয়েকটা ভাত নিয়ে মুখে দেয় আর সাথে সাথে তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে। ফিসফিস করে বলে, “অপূর্ব! অপূর্ব! একটা ভাতের যে এরকম স্বাদ হতে পারে আমি সেটা কোনোদিন কল্পনা করিনি! শুধু এই ভাত খেয়েই আমি দশটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারব। এই অপূর্ব চাল তুমি কোথায় পেয়েছে রতন?”
রতন সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে বলল, “এই তো পেয়েছি, আর কী! যাই হোক তুমি শুধু ভাত খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলো না। একটু সবজি খাও। একটু মাংস খাও।”
মানিক তখন লোভীর মতো সবজির বাটিটা নিজের কাছে টেনে এনে কয়েক চামচ সবজি নিয়ে তার দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর খুব সাবধানে এক টুকরো বাঁধাকপি নিয়ে মুখে দিয়ে চিবুতে থাকে। খাওয়ার আনন্দে তার সারা মুখ ঝলমল করতে থাকে, ধীরে ধীরে তার চোখ দুটো আধবোজা হয়ে যায়। মানিকের মুখ দিয়ে তৃপ্তির নানা রকম শব্দ বের হতে থাকে!
রতন তাকে ডাকল, “মানিক।”
“বলো।”
“আমার রান্না কেমন হয়েছে?”
মানিকের গলা আবেগে প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। কোনোভাবে কষ্ট করে বলল, “ভাই রতন, আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। তোমার মতো এত সুন্দর করে কেউ রান্না করতে পারবে না। আমি লক্ষ টাকা বাজি ধরতে পারি, সারা পৃথিবীতে তোমার মতো এত চমকার কেউ রান্না করতে পারবে না।”
রতন হাসি হাসি মুখ করে বলল, “থ্যাংকু মানিক। এখন তুমি খাও।”
মানিক তখন খেতে শুরু করল, একটু একটু করে খাবার মুখে দেয় এবং সাথে সাথে তার সারা শরীর আনন্দের একটা শিহরণ বয়ে যায়। তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে আর মুখ থেকে তৃপ্তির নানা ধরনের অব্যক্ত আনন্দের অস্পষ্ট শব্দ বের হতে থাকে। রতন নিজেও খায় কিন্তু তার মাঝে সেরকম বাড়াবাড়ি আনন্দের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। তার চোখে মুখে খানিকটা কৌতূহল এবং মুখে এক ধরনের হাসি তার চেয়ে বেশি কিছু সেখানে নেই।
মানিক তার খাওয়া শেষ করত বলে মনে হয় না, সে খেতেই থাকে এবং খেতেই থাকে। রতন এক সময় প্রায় জোর করে টেবিল থেকে খাবারের প্লেট আর বাটি সরিয়ে নিল তখন মানিক বাধ্য হয়ে তার খাওয়া। শেষ করে চেয়ার থেকে উঠে এল। বেশি খাওয়ার কারণে মানিক খুব ভালো করে নড়তে পারছিল না, কোনোমতে এসে সে সোফায় গড়িয়ে পড়ল। বিশাল একটা অশালীন ঢেকুর তুলে বলল, “রতন, আজকে তোমার রান্না খেয়ে আমি প্রথমবার অনুভব করলাম স্বর্গীয় অনুভূতি বলতে কী বোঝায়। তোমাকে আগে আমি বেশি গুরুত্ব দেইনি, কিন্তু যে এত চমৎকার, এত অসাধারণ রাধতে পারে তাকে আসলে মাথায় তুলে রাখা উচিত।”
রতন সামনে আরেকটা সোফায় বসে বলল, “মানিক। আমি আসলে রাঁধতে পারি না। এর আগেরবার তোমাকে যা খেতে দিয়েছিলাম, আজকেও আমি তোমাকে হুবহু একই জিনিস খেতে দিয়েছি।”
মানিক হা হা করে হাসল। বলল, “তুমি বললেই তো আর আমাকে সেটা বিশ্বাস করতে হবে না। আমি নিজেই তো খেয়েছি, রান্নার পার্থক্য স্বাদের পার্থক্যটা তো আমি নিজে দেখেছি।”
“তুমি দেখ নাই। এখানে অন্য একটা ব্যাপার কী ঘটেছে।”
মানিক জিজ্ঞেস করল, “কী ঘটেছে?”
রতন বলল, “মনে আছে, আমি তোমাকে বলেছিলাম, স্বাদের পুরো ব্যাপারটা আসলে মুখে ঘটে না, এটা ঘটে তোমার মস্তিষ্কে।”