রতন বলল, “হু।” কিন্তু তাকে দেখে বোঝা গেল সে মানিকের কথাটা শোনেনি, কিছু-একটা চিন্তা করছে।
মানিক বলল, “ইচ্ছে করলে তুমিও আমার সাথে আসতে পার। সুস্বাদু খাবার বলতে কী বোঝায় তুমি তার একটা ধারণা পাবে।”
রতন আবার বলল, “হু।”
এবারেও সে কিছু শোনেনি। মানিক বলল, “আমি কি যাব? তুমি কি আমার সাথে যাবে?”
রতন আবার বলল, “হুঁ।”
বোঝাই যাচ্ছে সে কিছু শুনছে না। ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্যে মানিক বলল, “তোমার ল্যাবরেটরির আলমারির ভেতরে কাঁচের বোতলে লাল রঙের কী যেন আছে। মনে হয় ভিনেগার–আমি খানিকটা ঢেলে নিয়ে গেলাম, বাসায় সালাদের মাঝে দিব।”
রতন বলল, “হু।”
মানিক তখন হাল ছেড়ে দিল। কোনো এক সময় রতন তাকে বলেছিল এই বোতলে মারাত্মক কী একটা এসিড, এটার থেকে দূরে থাকতে। সেটাকে ভিনেগার হিসেবে সালাদে দেয়া নিয়ে যখন রতনের মাথাব্যথা নেই তার মানে এখন সে কিছুই শুনছে না। মানিক আগেও দুই একবার রতনকে এভাবে চিন্তায় ডুবে যেতে দেখেছে। তাই সে আর এটা। নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে টেবিল থেকে উঠে হাত ধুয়ে দরজা খুলে বের হয়ে গেল। রতন ঠিক একইভাবে বসে রইল।
ঠিক দুই সপ্তাহ পর মানিক রতনের একটা এস.এম.এস পেল। সেখানে লেখা, “আজ রাতে তোমার আমার বাসায় খাবার দাওয়াত। খাবার মুখে দিয়ে ভালো না লাগলে তোমাকে খেতে হবে না।”
মানিক ঠিক করেছিল রতনের বাসায় অন্য সবকিছুর জন্যে সে যাবে কিন্তু খাওয়ার জন্যে কখনোই যাবে না। রতনের এস.এম.এস, পেয়ে সে অবশ্যি তার মত পাল্টালো। মুখে দিয়ে ভালো না লাগলে খেতে হবে না। এরকম কঠিন একটা কথা তো নিশ্চয়ই শুধু শুধু বলেনি নিশ্চয়ই সুস্বাদু। খাবারের আয়োজন করেছে।
সন্ধেবেলা রতনের বাসায় গিয়ে মানিক দেখল খাবার টেবিলে খাবার সাজানো। মানিক ভেবেছিল রতন নিশ্চয়ই অসাধারণ কিছু খাবার রান্না করে এনেছে কিন্তু দেখল আসলে সেরকম কিছু না। আগেরবার যেরকম কড়কড়ে কিছু ভাত, ত্যালত্যালে শবজি, ম্যাড়ম্যাড়া মাংস আর জ্যালজ্যালে ডাল ছিল, হুবহু সেই একই খাবার। শুধু তাই না সবকিছুতেই সেই কাঁঠাল পাতার মতো বাঁধাকপি। মানিকের প্রথমে মনে হলো এটা নিশ্চয়ই একটা রসিকতা। কিন্তু মানিক জানে রতনের নানা ধরনের গুণ তার মাঝে ছিটেফোঁটা রসিকতা নেই। কাজেই এটা কোনো রসিকতা নয়। মানিক শুকনো মুখে বলল, “এটাই তোমার আয়োজন?”
রতন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
“মুখে দিয়ে ভালো না লাগলে খেতে হবে না?”
“না।”
মানিক ইতস্তত করে বলল, “আমি যদি মুখে না দিয়েই বলি ভালো লাগছে না তাহলে?”
রতন ভুরু কুঁচকে বলল, “মুখে না দিয়ে কেমন করে বলবে?”
“সমস্যা কী? এর আগেরবার যখন আমাকে খেতে ডেকেছিলে কথন তুমি হুবহু এই একই খাবার দিয়েছিলে। একই রং একই চেহারা একই গন্ধ। তখন আমার খেতে যেরকম লেগেছিল এখন তার থেকে অন্যরকম লাগবে কেন?”
রতন চোখে-মুখে একটা রহস্যের ভঙ্গি করে বলল, “আগে একটু খেয়ে দেখো।”
মানিক খুবই দুঃশ্চিন্তার ভঙ্গি করে টেবিলে রাখা মাংসের বাটি থেকে চামচে করে একটু ঝোল নিয়ে মুখে দেয়ার চেষ্টা করল তখন হঠাৎ রতন “না না না” বলে প্রায় চিৎকার করে ছুটে এল। মানিক ভয় পেয়ে চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
রতন বলল, “তুমি এভাবে খেতে পারবে না। ঠিক করে বসে খেতে হবে।”
“ঠিক করে বসে? আমি শুধু একটু চেখে দেখছিলাম—“
“তুমি যদি চাখতেও চাও, ঠিক করে বসে চাখতে হবে।”
রতনের কাজকর্ম খুবই রহস্যজনক, কিন্তু মানিক বেশি অবাক হলো। বড়ো কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের আগে তার কাজকর্ম এরকম রহস্যময় হয়ে যায়। এখন মনে হয় সে তার কোনো নূতন আবিষ্কার দেখাবে কিন্তু কড়কড়ে ভাত আর ম্যাড়ম্যাড়া মাংস কী আবিষ্কার হতে পারে মানিক ভেবে পেল না। মানিক অবশ্যি কোনো প্রশ্ন করল না, একটা চেয়ারে বসতে গেল তখন রতন আবার “না না না” বলে প্রায় চিৎকার করে উঠল। মানিক আবার ভয় পেয়ে প্রায় চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“এই চেয়ারে বসে না। বসার জন্যে তোমাকে আরেকটা চেয়ার এনে দিচ্ছি।”
“মানিক অবাক হয়ে বলল, এই চেয়ারে বসলে কী হবে?”
রতন তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভিতর থেকে আরেকটা চেয়ার নিয়ে আসে। চেয়ারটা অন্য রকম, মাথার কাছে একটা বড়ো হেলমেটের মতো। উপরে নীচে আলো জ্বলছে। চেয়ারের পিছনে একটা বাক্স দেখে মনে হয় এটা কোনো এক ধরনের কম্পিউটার। ভেতর থেকে শো শো শব্দ করে বাতাস বের হচ্ছে। রতন চেয়ারটা রেখে বলল, “তুমি এই চেয়ারে বস।”
মানিক একটু ভয়ে ভয়ে বলল, “আ-আমি এই চেয়ারে বসব?”
“হ্যাঁ।”
“এখানে বিদঘুঁটে কীসব যন্ত্রপাতি লাগানো।”
“তোমার সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।”
মানিক বলল, “তুমি জান আমি যন্ত্রপাতি খুবই অপছন্দ করি।”
“জানি।”
“কাজেই এই চেয়ারে এত যন্ত্রপাতি নিয়ে আমি বসতে রাজি না।”
“তোমাকে তো সারাজীবন বসতে হবে না। কিছুক্ষণ বসতে হবে। অন্য চেয়ারে না বসে এই চেয়ারে বসে খেতে হবে।”
মানিক মুখ শক্ত করে বলল, “আমি রাজি না।”
রতন অবাক হয়ে বলল, “বসতে রাজি না?”
“না।”
“কেন?”
“যদি যন্ত্রটা আমাকে কিছু করে ফেলে?”
রতন বলল, “মানিক। তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যন্ত্র তোমাকে কিছু করে ফেলবে না। তুমি এই চেয়ারে বসো, তোমার যদি এতটুকু অস্বস্তি হয় সমস্যা হয় তুমি চেয়ার থেকে উঠে এসো! কেউ তোমাকে এই চেয়ারে বেঁধে রাখছে না।”