গাড়ি থেকে গোঁফওয়ালা ফর্সামতো উশকোখুশকো চুলের যে মানুষটা বের হয়েছে সেই হচ্ছে রতন কিন্তু মানিক তখনো সেটা জানত না।
রতন গাড়ি থেকে বের হয়ে এদিক সেদিক তাকাল এবং মনে হলো হঠাৎ করে মানিককে দেখতে পেল, তখন সে মানিকের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “আপনার কাছে কি চিউইংগাম আছে?”
মানিক থতমত খেয়ে গেল, অচেনা জায়গায় বিচিত্র একটা গাড়ি থেকে আজব একটা মানুষ হঠাৎ করে বের হয়ে যদি জিজ্ঞেস করে তার কাছে চিউইংগাম আছে কি না তাহলে থতমত খাওয়ারই কথা। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “না। আমার কাছে চিউইংগাম নেই। কখনো থাকে না।”
“ও!” রতন মনে হলো খুবই বিরক্ত হলো। খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তাহলে কি একটা এক টাকার কয়েন হবে?”
মানিক একটু অবাক হয়ে বলল, “না। আমার কাছে পাঁচ টাকার নোট আছে।”
“আমি নোট চাই নাই।” রতন মুখ শক্ত করে বলল, “আমি বলেছি এক টাকার কয়েন। তার কারণ এক টাকার কয়েন মেটালের তৈরি, গোল, আর ইলেকট্রিসিটি কনডাক্ট করে, সিল করার জন্যে পারফেক্ট।”
কথা শেষ করে রতন এমনভাবে মানিকের দিকে তাকাল যেন মানিক। একটা ছাগল কিংবা লাইটপোস্ট। মানিক কবিমানুষ সে সহজে রাগে না, গলার স্বর উঁচু করে না। তারপরেও এই বেয়াদব মানুষটার কথা শুনে তার। একটু রাগ হলো। অনেক কষ্ট করে গলার স্বরটা ঠান্ডা রেখে বলল, “আপনি কি ঘুংচি শব্দটার একটা ভালো প্রতিশব্দ বলতে পারবেন?”
রতন হকচকিয়ে গেল, জিজ্ঞেস করল, “কী বললেন?”
“বলেছি আপনি কি ঘুংচি শব্দটার একটা ভালো প্রতিশব্দ বলতে পারবেন?”
“ঘুংচি?”
“হ্যাঁ।”
“ঘুংচি মানে কী?”
“কোনো মানে নাই। সেইজন্যেই তো প্রতিশব্দ খুঁজছি।”
রতন এবারে অনেকক্ষণ মানিকের দিকে তাকিয়ে ভালো করে তাকে লক্ষ করল। উদাস উদাস চেহারা, গায়ে সুন্দর ফতুয়া, চোখে চশমা কাঁধে ঝোলানো বাহারি শান্তিনিকেতনি ঝোলা। দেখে মনে হয় না তার মাথায় গোলমাল আছে কিন্তু কথা শুনে রতনের সেরকমই মনে হচ্ছে। রতন ভুরু কুঁচকে বলল, “আপনি আমার কাছে ঘুংচি শব্দের অর্থ জানতে চাইছেন কেন? আমি কেমন করে জানব?”
“আপনি আমার কাছে চিউইংগাম চাইতে পারেন আর আমি আপনার কাছে ঘুংচির প্রতিশব্দ চাইতে পারব না?”
“চিউইংগাম আর ঘুংচি এক হলো?”
“চিউইংগাম থেকে ঘুংচি একশ গুণ ভালো।” মানিক কষ্ট করে মেজাজ ঠান্ডা রেখে বলল, “চিউইংগাম খায় অমার্জিত বর্বর মানুষেরা। মানব সভ্যতায় দুটি বড়ো বিষফোড়ার একটি হলো টেলিভিশন অন্যটি চিউইংগাম। বুঝেছেন? আর ঘুংচি হচ্ছে একটা নির্দোষ শব্দ।”
রতন তার কোমরে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “আপনি কি কখনো ডাক্তার দেখিয়েছেন?”
মানিক এবার সত্যি সত্যি রেগে উঠল, বলল, “কী বললেন?”
“আমি জিজ্ঞেস করছি আপনি কি কখনো ডাক্তার দেখিয়েছেন? আমার মনে হয় আপনার ব্লাড প্রেশারের সমস্যা আছে। কিংবা হয়ত ব্রেনে গোলমাল আছে। কিংবা অন্য জেনেটিক সমস্যা আছে। তা না হলে আমার একটা সোজা প্রশ্নের উত্তরে কেউ এত কথা বলে?”
“কী বললেন?” মানিক মেঘের মত গর্জন করে বলল, “আমি বেশি কথা বলি?”
“সবসময়ে বলেন কি না জানি না। কিন্তু এখন বলছেন।”
মানিক কিছুক্ষণ সরুচোখে রতনের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আমার মনে হয় কী জানেন? আমার মনে হয় আপনারই ব্লাড প্রেশার আছে। শুধু ব্লাড প্রেশার নয় আপনার প্লীহারও প্রেশার আছে।”
রতন থতমত খেয়ে বলল, “প্লীহার প্রেশার?”
“হ্যাঁ।”
“প্লীহা কী?”
“আমি জানি না।”
রতন অবাক হয়ে বলল, “আপনি জানেন না? তাহলে যে বললেন?”
“বলেছি তো কী হয়েছে? একটা জিনিস না জানলে সেটা বলা যাবে না?”
“একটা জিনিস না জানলে কেন সেটা বলবেন?
“আমরা বলি। সবসময় বলি। যে শব্দটা আমি জানি সেটা বলি, যেটা জানি না সেটাও বলি। যে শব্দ পৃথিবীতে নেই আমরা সেই শব্দ তৈরি করে সেটাও বলি।”
রতন কিছুক্ষণ অবাক হয়ে মানিকের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “ঘুংচুর মতন?”
“হ্যাঁ। ঘুংচুর মতন।”
“আপনারা কারা?”
“আমরা কবি।”
“সত্যিকারের কবি?”
মানিক মুখ শক্ত করে বলল, “কবি কখনো মিথ্যাকারের হয় না। কবি মানেই সত্যিকারের কবি।”
রতন বলল, “আমি এর আগে সামনাসামনি কখনো কোনো কবি দেখি নাই।” চোখ বড়ো বড়ো করে মানিকের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “কবিরা তাহলে এরকম হয়? আমি ভেবেছিলাম “ রতন হঠাৎ কথার মাঝখানে থেমে গেল।
মানিক বলল, “কী ভেবেছিলেন?”
“আমি ভেবেছিলাম কবিদের লম্বা লম্বা উশকোখুশকো চুল আর দাড়ি হয়। লাল লাল চোখ হয়। ময়লা পাঞ্জাবি পরে থাকে। মাথার চুলে রতন আবার কথার মাঝখানে থেমে গেল।
মানিক জিজ্ঞেস করল, “মাথার চুলে কী?”
“মাথার চুলে উকুন হয়।”
মানিক মুখ শক্ত করে বলল, “আপনাদের এটা খুবই ভুল ধারণা। কবিরা মোটেই নোংরা খবিশ না। কবিরা সুন্দরের পূজারি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং পূত পবিত্র। নোংরা খবিশ কারা জানেন?”
“কারা?”
“বৈজ্ঞানিকেরা। তাদের দশ হাতের মাঝে আপনি যেতে পারবেন না। শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হয়।
রতন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “দুর্গন্ধ বের হয়?”
“হ্যাঁ। গোসল করে না তো–দুর্গন্ধ বের হবে না তো কী বের হবে? তার উপর তাদের কথাবার্তা হয় চাছাছোলা কাঠখোট্টা রুক্ষ। তারা অসামাজিক, কারো সাথে মিশতে পারে না। চোখের নীচে থাকে কালি, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, নখের নীচে ময়লা–”