মানিক বলল, “এই প্রথম?”
“কেন? প্রথম কেন হবে? আমি প্রত্যেক দিন রাধি।”
মানিক ইতস্তত করে বলল, “তুমি বৈজ্ঞানিক মানুষ। বড়ো বড়ো বৈজ্ঞানিক গবেষণা করবে। রান্না-বান্না করে সময় নষ্ট করো কেন?”
রতন বলল, “আমার রান্না করতে মোটেও সময় নষ্ট হয় না।”
“সময় নষ্ট হয় না?
“না।”
“কেন?”
“রান্না করার জন্য আমার রান্না করার যন্ত্রে শুধু ডায়ালটা ঘুরিয়ে সুইচটা টিপতে হয়। যেমন এই যে গরুর গোশতটা তুমি খাচ্ছ এটা রান্না করার জন্যে আমি ডায়ালটা সেট করেছি হালকা ঝাল, ভুনা সঙ্গে আলু। সবজিটার জন্যে সেট করেছি আলু, ফুলকপি, গাজর আর বরবটি। ডাল ছিল মসুর এবং মুগ এক সাথে স্পেসিফিক গ্রাভিটি টু পয়েন্ট ফাইভ–”
মানিক হাত তুলে রতনকে থামাল, “দাঁড়াও, দাঁড়াও। তোমার গোশতে কোনো আলু নেই। কী একটা আছে এটা কার্ডবোর্ড হতে পারে, কাঁঠাল পাতাও হতে পারে। সবজিতে আলু ফুলকপি আর গাজর নেই, আবার সেই কাঁঠাল পাতা আছে। আর ডাল–”
রতন এবারে মানিককে থামাল। বলল, “এটা আসলে কাঁঠাল পাতা। এটা হচ্ছে বাঁধাকপি। আর গোশতে আলু না দিয়ে যে বাঁধাকপি দেয়া হয়েছে তার একটা কারণ আছে। এলগরিদমে দেয়া আছে যে গোশতের পরিমাণের সাথে আলুর পরিমাণ যদি আনুপাতিক না হয় তাহলে মেশিন একটা বিকল্প সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে খানিকটা স্বাধীনতা দেয়া আছে। খাবারের পুষ্টি ক্যালোরি অপটিপমাইজেশানে–”
মানিক হাত তুলে থামাল, বলল, “তোমার বিজ্ঞানের কচকচি থামাও। তুমি আসলে রান্না কর না। তোমার যন্ত্র রান্না করে। তুমি অনেক ভালো ভালো যন্ত্র আবিষ্কার করেছ কিন্তু আমি দুঃখিত–কথাটা নিষ্ঠুর হলেও বলতে হবে, তোমার রান্না করার যন্ত্রটা ভালো হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি এই যন্ত্র চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে।”
রতন বলল, “কেন? তুমি এই কথা কেন বলছ?”
“যেমন মনে করো এই গোশতের ব্যাপারটা। এখানে সাবানের গন্ধ।”
রতন বলল, “গোশতকে সাবান দিয়ে ধুলে একটু সাবানের গন্ধ থাকতেই পারে।”
“গোশতকে কেউ কখনো সাবান দিয়ে ঘোয় না। সেটা যদি ছেড়েও দেই, এই গোশত রান্না হয়নি, এটা কাঁচা।”
“খাবারকে বেশি রান্না করলে তার ভাইটামিন নষ্ট হয়ে যায়। পুষ্টি কমে আসে।”
মানিক মাথা নাড়ল, বলল, “পুষ্টির জন্যে কাঁচা মাংস খাওয়া যদি জরুরি হয় তাহলে আমি নিশ্চয়ই সারমেয় হয়ে জন্মাতাম।”
রতন ভুরু কুচকে বলল, “সারমেয় মানে কী?”
“সারমেয় মানে কুকুর। আমি কুকুর না। আমি কাঁচা গোশত খাব না।”
রতন বলল, “আমাদের খেতে হয় শরীরকে রক্ষা করার জন্যে। এই টেবিলে যে খাবার দেয়া আছে তুমি যদি নিয়মিত সেটা খাও তোমার শরীরের সকল প্রয়োজন মিটবে। কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট ভাইটামিন–”
মানিক বলল, “আমি তোমার কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট আর ভাইটামিনের শীতবস্ত্র দহন করি।”
রতন অবাক হয়ে বলল, “কী বললে?”
“আমি অমার্জিত এবং অশালীন কথা বলি না। যদি বলতাম তাহলে বলতাম আমি তোমার কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট আর ভাইটামিনের খেতা পুড়ি।”
রতন একটু অবাক হয়ে বলল, “ও! তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে। তুমি আমার রান্না পছন্দ করনি।”
মানিক বলল, “বলাটা ভদ্রতা নয় কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি তোমার এই রান্না করা খাবার পুরোপুরি অখাদ্য।”
রতন একটু ইতস্তত করে বলল, “এর পুষ্টিগুণ ঠিক আছে।”
“মানুষ পুষ্টিগুণের জন্যে খায় না। একজন মানুষের জীবনে আনন্দের যে কয়টা বিষয় আছে তার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাবার। আমরা মানুষ হিসেবে সেই খাবার উপভোগ করতে চাই।”
“সত্যি?”
“তুমি যদি এটা জেনে না থাকো তাহলে আমি তোমার জন্যে করুণা অনুভব করি। বিজ্ঞান যেরকম একটা বিষয়, রান্না করাও একটা বিষয়। রন্ধনশাস্ত্রের উপর কত বই লেখা হয়েছে তুমি জানো?”
“নেটে সার্চ দিয়েই তো সব রেসিপি পাওয়া যায়।”
“সেটা তুমি দিতে থাকো। কিন্তু পৃথিবীতে ভালো ভালো রেস্টুরেন্ট তৈরি হয়েছে। মানুষ সেখানে গিয়ে খাবার উপভোগ করে।”
রতনের মুখ দেখে মনে হলো এই পুরো বিষয়টা বুঝি সে এই প্রথম জানতে পেরেছে। মানিক প্লেট থেকে হাত সরিয়ে বলল, “যে খাবার খেতে ভালো না আমি সেটা খাব না। তার মাঝে যত পুষ্টিই থাকুক না কেন।”
রতন বলল, “তুমি একটা জিনিস জানো?”
“কী?”
“এই যে তুমি ভালো স্বাদের কথা বলছ সেই স্বাদটা কোথায়?”
“আমার মুখে। তুমি যদি এখনো না জেনে থাক তাহলে তোমাকে জানিয়ে দিই আমরা মুখ দিয়ে খাই। তাই স্বাদটাও আমাদের মুখে।”
রতন বলল, “তোমার ধারণা হচ্ছে আমরা মুখ দিয়ে খাই তাই স্বাদের অনুভূতিটা আসে মুখ থেকে, আসলে
“আসলে কী?”
সবকিছু আমাদের মস্তিষ্কে। কোনো একটা কিছু খেতে যে আমাদের ভালো লাগে তার কারণ সেটা খেতে ভালো তা নয়। তার কারণ তখন আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের একটা সিগন্যাল দেয়। সেই সিগন্যালটা আসে নিউরনের সিনান্স কানেকশন থেকে। যখন একটা সিনা “।
মানিক হাত তুলে থামাল, “তোমার সিনাঙ্গের শীত বস্ত্র দহন করি।”
রতন তখন থতমত খেয়ে থেমে গেল। মানিক বলল, “তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে আমি খাবার টেবিল থেকে উঠে হাত ধুয়ে বাইরে যাব। মোড়ের খাবারের দোকান থেকে শিক কাবাব আর নানরুটি খেয়ে বাসায় যাব।”