মিই বলল, “দেব। মরা ইন্দুর দিতে হবে কি না বলেন। মেরে নিয়ে আসব।”
রতন বলল, “না, মরা ইঁদুর লাগবে না। শুধু লক্ষ রেখো সবসময়েই কালাচান ধলাচানের যেন কিছু-একটা করার থাকে। ভিতরে কাগজ কলম আছে। ইলেকট্রনিক গিটার আছে, নানারকম খেলনা আছে, সেগুলো যেন থাকে।”
“থাকবে। ক্রিকেট ব্যাট ফুটবল দিতে হলে–”
“দিতে হবে না। আর যদি কোনো ইমার্জেন্সি হয় আমাকে ফোন করো।”
“করব। আপনার নম্বর আমার মুখস্থ।”
“গুড।” রতন এক মুহূর্ত থেমে বলল, “আর মনে আছে তো? নো সাংবাদিক।”
“মনে আছে। কোনো সাংবাদিক টিভি ক্যামেরা ধারে কাছে আসতে পারবে না। কাছে আসলেই—“
মিঠু হাত দিয়ে গলায় পোচ দেবার ভঙ্গি করল।
.
কালাচান ধলাচানকে দেখার জন্যে সারা স্কুল ভেঙে পড়ল। যারা নিজেরা নানারকম বিজ্ঞানের প্রজেক্ট নিয়ে এসেছে তার পর্যন্ত তাদের প্রজেক্ট ফেলে রেখে কালাচান ধলাচানকে দেখতে এল। মিঠু দরজার মাঝে তার ভলান্টিয়ার দাঁড় করিয়ে রাখল, ঘরে ঢোকার আগে সবাইকে বুকে হাত দিয়ে বলতে হলো, “আমি খোদার নামে কসম খেয়ে বলছি, এই রুমে। যেটি দেখব সেটি কাউকে বলব না। যদি বলি তাহলে জাহান্নামের আগুনে যেন আমি জ্বলে পুড়ে মরি।”
ভেতরে বড়ো খাঁচা, খাঁচার সামনে কাঁচ এবং তার ভেতর দিয়ে কালাচান ধলাচানকে দেখা যাচ্ছে। তারা সবসময়েই কিছু না কিছু করছে। খাবার সময় তাদের রবোটিক হাত দিয়ে প্যাকেট খুলে কিছু না কিছু খাচ্ছে। সফট ড্রিংকের বোতলের ছিপি খুলে ঢক করে ড্রিংকস মুখে ঢেলে দিচ্ছে। কাগজ বিছিয়ে তার ওপর রঙিন কলম দিয়ে ছবি আঁকছে। একটা গিটার আছে সেটা বাজাচ্ছে। কখনো কখনো দুজনে আবার ধাক্কাধাক্কি করছে, মনে হয় এটা তাদের এক ধরনের খেলা।
স্কুলের ছেলেমেয়েরা ভিড় করে কালাচান ধলাচানকে দেখছে। এত ছেলেমেয়ে দেখে প্রথম প্রথম কালাচান ধলাচান একটু ভড়কে গিয়েছিল কিন্তু বেশ তাড়াতাড়ি তারা ব্যাপারটা মেনে নিল। শুধু যে মেনে নিল তাই না ছেলেমেয়েরা কিছু-একটা বললে সেটা তারা অবিকলভাবে বলারও চেষ্টা করতে লাগল।
ছেলেমেয়েদের এই প্রচণ্ড ভিড় দেখে মিঠু মহাখুশি, অহংকারে তার মাটিতে পা পড়ে না এরকম অবস্থা। যেই আসছে তাকেই সে বলছে, “বুঝলি, এই যে দুইটা ফাটাফাটি কাক দেখছিস সেগুলি কে দিয়েছে জানিস? আমি (এই সময় সে তার বুকে একটা থাবা দেয়!)। কাক দুইটার হাত কে লাগিয়েছে জানিস? (সবাই উৎসুক হয়ে শোনার জন্যে তাকায় তখন সে ঘাড় বাঁকা করে বলে) পৃথিবীর কেউ সেটা জানে না। টপ সিক্রেট প্রজেক্ট।”
বাচ্চারা গভীরভাবে মাথা নাড়ে, তাদের নানারকম প্রশ্ন থাকে এবং মিঠু বানিয়ে বানিয়ে তার উত্তর দিতে থাকে। কাকের হাত লাগানোর পর এই টপ সিক্রেট সায়েন্টিস্ট মানুষের পাখা লাগানোর একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু করবে এই ধরনের একটা খবর সে ঘোষণা করে দিল। পানির নীচে নিশ্বাস নিতে পারে এই রকম একটা মেয়ে তৈরি করা হয়ে গেছে এই খবরটাও সে ছড়িয়ে দিল। কপালের উপর তিন নম্বর একটা চোখ লাগানোরও একটা গোপন প্রজেক্ট আছে সেটা সে খুবই গোপনে শুধু অল্প কয়েকজনকে বলল।
স্কুলের ছেলেমেয়েরা টপ সিক্রেট প্রজেক্টের কথা শুনে বিদায় নিলেও স্যার ম্যাডামরা তাকে এত সহজে ছাড়লেন না। কালাচান ধলাচান কোথা থেকে এসেছে কে তৈরি করেছে তাদের এরকম অসংখ্য প্রশ্ন। মিঠু অবশ্যি মুখ শক্ত করে জানাল, “এটা বলার পারমিশন নাই।” স্যার ম্যাডামরা তাকে ধমকাধমকি করলেন কিন্তু মিঠু মুখ খুলল না।
বিকেলবেলা যখন সায়েন্স ফেয়ার শেষ হয়েছে তখন কালাচান। ধলাচানের খাঁচাটা কালো কাপড়টা দিয়ে ঢেকে দিল। স্কুলের দপ্তরিটা যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের ঘরটাতে তালা না মারল মিঠু সামনে থেকে নড়ল না। দপ্তরি চলে যাবার পর মিঠু ঘরের দরজার মাঝে আরো একটা তালা লাগিয়ে দিল, বুদ্ধি করে বাসা থেকে সে আরেকটা তালা নিয়ে এসেছে। সায়েন্টিস্ট চাক্ষুকে সে কথা দিয়েছে কালাচান ধলাচানকে সে দেখেশুনে রাখবে।
মিঠু আর তার দলের ছেলেমেয়েরা ভেবেছিল পরের দিন বুঝি ভিড় কম হবে, কিন্তু দেখা গেল ছেলেমেয়েদের উৎসাহের কোনো কমতি নেই। পরের দিন ভিড় আরো বেশি। দরজায় পাহারা বসানো হয়েছে যেন কোনো সাংবাদিক চলে আসতে না পারে। সায়েন্টিস্ট চাচ্চুকে কথা দিয়েছে কোনোভাবেই কোনো সাংবাদিক যেন খবর না পায় তাই তারা খুবই সতর্ক। যদিও তারা মোটেও বুঝতে পারছে না কেন সাংবাদিকদের এটা দেখানো যাবে না। তারা বরং এতদিন উলটোটাই জেনে এসেছে যা কিছু সম্ভব সাংবাদিকদের জানাতে হবে।
গেটে যখন ভলান্টিয়ারদের ধাক্কাধাক্কি করে ছেলেমেয়েরা কালাচান ধলাচানকে দেখতে আসছে তখন মিঠু সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পাশে রিমি দাঁড়িয়েছিল, তাকে বলল, “বুঝলি রিমি, একটা ভুল হয়ে গেছে।”
“কী ভুল?”
“দুই টাকা করে টিকেট ধরা উচিত ছিল। তাহলে একদিনে বড়োলোক হয়ে যেতাম।”
“পাঁচ টাকা করে টিকেট ধরে রাস্তার পাবলিককে ডেকে আন, আরো তাড়াতাড়ি আরো বড়োলোক হয়ে যাবি।”
“সাংবাদিকদের ডেকে আনলে তো আরো বেশি টাকা বানাতে পারতাম।”
ঠিক এইরকম সময় গেটের ভলান্টিয়ারদের ধাক্কা দিয়ে গুল্লু ভিতরে ছুটে এল, হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার করে বলল, “সর্বনাশ হয়েছে।”