রতন অবাক হয়ে দেখল, কলাচান কিছুক্ষণ মিঠুর হাতটার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল! মিঠু আনন্দে চিৎকার করে বলল, “হুশ!”
ছোটো বাচ্চাদের আনন্দ ভয়ংকর সংক্রামক একটা বিষয়। কালাচান ধলাচানকে ঘিরে তাদের আনন্দোল্লাস লাফ-ঝাঁপ দেখে কিছুক্ষণের মধ্যে। রতন আর মানিকও অনেকটা ছেলেমানুষের মতো হয়ে গেল। তাদের সাথে হাসাহাসি করতে লাগল। কালাচান ধলাচানের প্রতিভার যে বিষয়গুলো রতন গবেষণা করেও বের করতে পারেনি কিছুক্ষণের মধ্যে বাচ্চাগুলো সেগুলোও আবিষ্কার করে ফেলল। যেমন হাত নেড়ে তারা যদি নাচানাচি করে তাহলে কালাচান ধলাচানও হুবহু তাদের অনুকরণ করে হাত পা নেড়ে নাচানাচি করে। সবচেয়ে মজা হলো যখন মিঠু আনন্দে চিৎকার করে বলল, “হুশ!” আর কালাচানও অবিকল মিঠুর গলার স্বরে বলল, “হুশ!” কাক যে মানুষের গলার অনুকরণ করে শব্দ করতে পারে সেটা তারা কেউ। জানত না।
মেয়েটি কিছুক্ষণ নাচানাচি করে হঠাৎ ঘুরে রতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “সাইন্টিস্ট চাচ্চু, কালাচান ধলাচানকে আমাদের স্কুলে নিয়ে যেতে পারি? অন্যদের দেখাব!”
রতন একটু থতমত খেয়ে বলল, “তোমাদের স্কুলে নেবে?”
মিঠু মেয়েটিকে থামিয়ে বলল, “ধুর বেকুব! কালাচান আর ধলাচান অনেক স্পেশাল। সারা পৃথিবীতে একটাও নাই! এটা কি খেলনা নাকি যে আমাদের স্কুলে নেব! “
অন্য ছেলেটিও মাথা নাড়ল, বলল, “এইটা কোটি টাকার থেকে বেশি মূল্যবান। তাই না সাইন্টিস্ট চাচ্চু?”
রতনকে এর আগে কেউ সাইন্টিস্ট চাচ্চু ডাকেনি। সে তার নূতন পরিচয়ে বেশ মজা পেল বলে মনে হলো। হাসতে হাসতে মেয়েটিকে বলল, “তোমরা কালাচান ধলাচানকে তোমাদের স্কুলে নিতে চাও?”
মেয়েটি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ। নিতে চাই।”
“তোমাদের স্কুলের স্যার ম্যাডামরা আপত্তি করবে না? ক্লাশে মানুষের বাচ্চা যাবার কথা, কাকের বাচ্চা গেলে কেমন দেখাবে?”
মিঠু হি হি করে হেসে বলল, “কালাচান ধলাচানের বুদ্ধি আমাদের ক্লাশের অনেক ছেলেমেয়ে থেকে বেশি!”
মেয়েটি বলল, “অনেক স্যার ম্যাডাম থেকে বেশি।“
রতন বলল, “সেটা ঠিক আছে, কিন্তু স্কুলে কাকের বাচ্চা নেবে কীভাবে? রাখবে কোথায়?”
মিঠু তো তার ছেলেমানুষি মুখ বড়ো মানুষের মতো গম্ভীর করে বলল, “সাইন্টিস্ট চাচ্চু, আপনি সেটা নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমাদের স্কুলে সায়েন্স ফেয়ার হচ্ছে। সায়েন্স ফেয়ারে সবকিছু নেয়া যায়। এর আগেরবার ক্লাশ নাইনের রত্নাপু একটা গরু নিয়ে এসেছিল।”
“গরু?” রতন অবাক হয়ে জানতে চাইল, “গরু কেন?”
“গরুর হজম প্রক্রিয়া দেখানোর জন্যে।”
রিমি মনে করিয়ে দিল, “সায়েন্স ফেয়ার শেষ হবার পর কতদিন ক্লাশে গোবরের গন্ধ ছিল মনে আছে?”
মিঠু বলল, “সায়েন্স ফেয়ারের সময় কাক গরু ছাগল সবকিছু নিতে দিবে।” তারপর খুব আশা নিয়ে বলল, “দেবেন নিতে?”
রতন বলল, “এক শর্তে দিতে পারি?”
তিনজন একসাথে জিজ্ঞেস করল, “কোন শর্তে?”
“তোমাদের স্কুলের ছেলেমেয়ে ছাড়া আর কেউ কালাচান ধলাচানের কথা জানতে পারবে না।”
তিনজন একসাথে চিৎকার করে বলল, “জানবে না। খোদার কসম।”
রতন বলল, “খোদার কসম দিতে হবে না, তোমরা কথা দিলেই যথেষ্ট।”
মিঠু হুংকার দিয়ে বলল, “কথা দিলাম।”
“আরো একটা কথা।”
“কী কথা?”
“কোনো সাংবাদিক টেলিভিশন চ্যানেল পত্রিকার ফটোগ্রাফার কেউ যেন এটার কথা জানতে না পারে।”
“জানবে না।” রিমি এবারে হুংকার দিয়ে বলল, “কোনো সাংবাদিকদের আমরা স্কুলেই ঢুকতে দেব না। ঢোকার চেষ্টা করলে ঠ্যাং ভেঙে দেব।”
মানিক একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “ঠ্যাং শব্দটা অসুন্দর। আর সাংবাদিকতা খুবই মহান পেশা। তাই সাংবাদিকদের সম্পর্কে। অসম্মানজনক কথা বলা ঠিক নয়।”
রিমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “আপনি সাংবাদিক?”
“না, আমি ঠিক সাংবাদিক না, তবে আমি সংবাদপত্রে মাঝেমধ্যে লেখালেখি করি।”
“আপনি লেখক?”
মানিক মুখে একটা আলগা গাম্ভীর্য নিয়ে এসে বলল, “আসলে আমি কবি।”
“কবি?” তিনজন একসাথে বিস্ময় প্রকাশ করল। মিঠু বলল, “আসলে আমি কখনো সত্যিকারের কবি দেখি নাই।”
তারপর মানুষ যেরকম করে একটা বিচিত্র প্রাণী দেখে সেভাবে ঘুরে ঘুরে তাকে দেখল। একজন তার আঙুলগুলো টিপে দেখল। দেখা শেষ হবার পর মিঠু বলল, “হুশ!”
রতন বলল, “তাহলে কথা দিচ্ছ তোমরা কোনো সাংবাদিককে কালাচান ধলাচানকে দেখতে দেবে না?”
তিনজন একসাথে বলল, “কথা দিচ্ছি।”
তারা স্পষ্ট শুনল কালাচান আর ধলাচানও বলল, “কথা দিচ্ছি।”
রতন বলল, “ঠিক আছে। তোমরা তোমাদের স্কুলের ঠিকানা দাও। যেদিন সায়েন্স ফেয়ার সেদিন আমি কালাচান ধলাচানকে তোমাদের স্কুলে দিয়ে আসব। দুইদিন পর আবার নিয়ে আসব।”
তিনটি বাচ্চা এত জোরে তাদের মাথা নাড়ল যে মনে হলো মাথা বুঝি তাদের ঘাড় থেকে খুলে আসবে!
বাচ্চাগুলো চলে যাবার পর মানিক বলল, “কাজটা কি ঠিক হলো? এত ছোটো বাচ্চাদের হাতে এত মূল্যবান দুটো কাকের বাচ্চাকে তুলে দিচ্ছ?”
রতন বলল, “এই কাকের বাচ্চা দেখে স্কুলের ছেলেমেয়েরা যদি একটু আনন্দ পায় সমস্যা কী?”
মানিক ফোঁস করে খুব লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কী জন্যে কে জানে!
.
নির্দিষ্ট দিনে রতন কালাচান আর ধলাচানকে একটা কালো কাপড়ে ঢাকা বড়ো খাঁচার ভিতরে ভরে মিঠুদের স্কুলে গিয়ে তাদের হাতে তুলে দিল। মিঠু তার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে স্কুলের গেটে অপেক্ষা করছিল, তারা মহা উৎসাহ নিয়ে খাঁচাটাকে ভিতরে নিয়ে গেল। রতন সাথে একটা প্যাকেট দিয়ে বলল, “এর ভেতরে কালাচান ধলাচানের খাবার আছে। প্রত্যেক ঘণ্টায় একবার করে দুজনকে দুটো প্যাকেট খাবার আর দুটো ড্রিংকের বোতল দিও।”