“ছেড়ে দেবে?” মানিক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, “তুমি এদের ছেড়ে দেবে?”
“হ্যাঁ। হাত থাকার কারণে তারা অনেক কিছু করতে পারে যেটা অন্য কাকেরা করতে পারে না। তাই কাকদের সমাজে অন্য কাকেরা মনে হয় কালাচান ধলাচানকে নিবে না। তাই হাত খুলে স্বভাবিক কাক বানিয়ে এখন এদের ছেড়ে দিতে হবে।”
মানিক বলল, “কখন ছাড়বে?”
“আজকেই ছেড়ে দেবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মিঠুকে না দেখিয়ে ছাড়া ঠিক হবে না।”
“মিঠু কে?”
“যে বাচ্চাটা কালাচান ধলাচানকে এনে দিয়েছে।”
“তাকে কখন দেখাবে?”
“আমি তাকে ফোন করে খবর দিয়েছি, আজ কাল কোনো এক সময় চলে আসবে।”
মানিক কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইল, তারপর বলল, “রতন, তুমি মনে হয় একটা বিষয় বুঝতে পারছ না।”
“কী বিষয়?”
“তোমার এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথা মানুষের জানা দরকার।”
“যুগান্তকারী আবিষ্কার?”
“হ্যাঁ। আমরা আগে জানতাম শুধু মানুষের বুঝি নান্দনিক বোধ আছে। তুমি দেখালে শুধু মানুষ নয় পাখিদের ভেতরেও সেই শিল্পবোধ আছে। সৃষ্টিশীলতা আছে। এই অসাধারণ সত্যটি আমাদের সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। সবাইকে জানাতে হবে–”
“সবাইকে জানাতে হবে?” রতন চোখ কপালে তুলে বলল, “সর্বনাশ!”
মানিক বলল, “সর্বনাশ? সর্বনাশ কেন হবে? আমি অনেক পত্র-পত্রিকার সাংবাদিকদের চিনি। টেলিভিশন চ্যানেলের লোকজনকে চিনি। তাদের খবর দিলেই চলে আসবে। পত্র-পত্রিকায় সংবাদ ছাপাবে। টেলিভিশনে টক শো হবে। সাংবাদিক সম্মেলন হবে।”
রতন মাথা নেড়ে বলল, “মানিক, তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না। আমি দুইটা জিনিসকে ভয় পাই। কোমাডো ড্রাগন আর সাংবাদিক।”
মানিক মুখ শক্ত করে বলল, “কেন? তুমি সাংবাদিকদের কেন ভয় পাও? তুমি জান সাংবাদিকতা অনেক মহান পেশা।”
“সেই জন্যেই ভয় পাই। আমার নিরিবিলি জীবন একেবারে ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে যাবে।”
মানিক মেঘস্বরে বলল, “ছ্যাড়াব্যাড়া বলে বাংলা ভাষায় কোনো শব্দ নেই। শব্দটি অত্যন্ত অশালীন।”
“ঠিক আছে আমার জীবনটা আউলাঝাউলা হয়ে যাবে।”
“এই শব্দটিও যথেষ্ট অমার্জিত–কিন্তু সেটা আলোচনার বিষয় নয়। আমি জানতে চাই কেন তুমি সাংবাদিকদের ভয় পাও?”
“তার কারণ সাংবাদিকেরা বাড়িয়ে চাড়িয়ে সবকিছু বলবে, তখন অন্য সাংবাদিকেরা দেখতে আসবে। তারা আরো বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলবে। তখন আরো সাংবাদিকেরা আসবে এইভাবে সবার কাছে জানাজানি হয়ে যাবে! আমি সেটা চাই না। আমি নিরিবিলি নিজের কাজ করতে চাই।”
“কিন্তু এত বড়ো একটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার–”
রতন বলল, “আমি শুধু মজা করতে চাই। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের খেতা পুড়ি!”
মানিক হতাশভাবে মাথা নাড়ল, “খেতা পুড়ি খুবই অমার্জিত কথা। শব্দটা কথা “
“যাই হোক। আমি কোনো পাবলিসিটি চাই না। পাখি নিয়ে গবেষণা শেষ হয়েছে এখন নূতন গবেষণা হবে।”
“কিন্তু দেশের মানুষ এটা সম্পর্কে জানবে না? যদি না জানে “
মানিক বিশাল একটা বক্তৃতা দেয়া শুরু করেছিল কিন্তু ঠিক তখন দরজায় শব্দ হলো। রতন দরজা খুলে দেখে মিঠু দাঁড়িয়ে আছে। আজকে তার সাথে একজন ছেলে এবং একজন মেয়ে। মিঠুকে যদি মৃত্যু ডাকা হয় তাহলে তার সাথে যে দুজন আছে তাদেরকে বিভীষিকা না হয় আতংক ডাকা যেতে পারে। তবে তাদের নাম বিভীষিকা বা আতংক নয়। ছেলেটির নাম গুল্লু, মেয়েটি রিমি।
মিঠু বলল, “এই যে এরা বিশ্বাস করতে চায় না আপনি কাকদের ট্রেনিং দিচ্ছেন।”
রিমি নামের মেয়েটি বলল, “মিঠু দশটা কথা বললে তার মাঝে নয়টা মিথ্যা কথা থাকে।”
মিঠু বলল, “কোনোদিনও না। আমি কোনোদিন মিথ্যা কথা বলি না।”
রিমি রতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই দেখেন, কত বড়ো মিথ্যা কথা বলল।”
রতন বলল, “অন্য সময় মিঠু কী বলে আমি জানি না এইবারে সত্যি কথাই বলেছে। আমি আসলেই দুটি কাকের বাচ্চাকে ট্রেনিং দিচ্ছি।”
রতন কথা শেষ করার আগেই বাচ্চাগুলো টেবিলে রাখা কালাচান ধলাচানকে দেখতে পেল। কালাচান তখন একটা বোতল খুলছে, ধলাচান আরেকটা বোতল খুলে দুই হাতে ধরে ঢক্ করে কিছু-একটা খাচ্ছে। বাচ্চাগুলো বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে কাক দুটোর দিকে ছুটে গেল। মিঠু বলল, “হুশ!”
রিমি নামের মেয়েটি বলল, “মাইয়ারে মাইয়া!”
গুল্লু নামের দ্বিতীয় ছেলেটি বলল, “বুংগা বুংগা!”
রতন লক্ষ করল এই শব্দগুলো যে বাংলা ভাষায় নেই এবং শব্দগুলো যে অমার্জিত সেটা নিয়ে মানিক কোনো কথা বলল না বরং চোখ বড়ো বড়ো করে বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। মিঠু এবং তার পিছু পিছু ছেলে এবং মেয়েটি টেবিলটার দিকে এগিয়ে যায়। মিঠু চিৎকার করে ডাকল, “কালাচান! ধলাচান!”
কালাচান আর ধলাচান তাদের হাতের ড্রিংকের বোতল দুটি নীচে নামিয়ে মিঠুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “কা। কা।”
মিঠু আনন্দে লাফ দিয়ে বলল, “আমার সাথে কথা বলেছে! কথা। বলেছে! হুশ! হুশ!!”
তখন গুল্লু এবং রিমিও এগিয়ে গিয়ে কাক দুটোকে ডাকল, “কালাচান! ধলাচান!”
কাক দুটো তাদের কোল্ড ড্রিংকের বোতল থেকে মুখে ঢক্ করে খানিকটা ড্রিংক ঢেলে গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, “কা কা।”
বাচ্চাগুলো কাক দুটোকে ঘিরে লাফালাফি চেঁচামেচি করতে থাকে। মিঠু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “হ্যান্ডশেক! হ্যাঁন্ডশেক!”