রতন অবশ্যি খুব নিরুৎসাহিত হলো না, শুরুতে এরকম কিছু-একটা ঘটবে সেটা অনুমান করেছিল। কাকের বাচ্চা দুটির হাতগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেকদিন সময় লাগবে এটা সে ধরেই রেখেছিল। রতন ধৈর্য ধরে লেগে রইল, প্রত্যেকদিন একটু পর পর সে সার্কিট অন করতে থাকে।
এক সপ্তাহের মাথায় প্রথমে ধলাচান তার রবোটিক হাতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারল। ব্যাপারটা ঘটল হঠাৎ করেই, ধলাচান হঠাৎ করে বুঝে গেল কীভাবে হাত দুটিকে কাছে আনতে হয় আবার দূরে নিতে হয়। তখন সে বারবার হাত দুটিকে কাছে আনতে থাকে আবার দূরে নিতে থাকে। কালাচান তখনও ব্যাপারটা ধরতে পারেনি তার হাত দুটো মোটামুটি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নড়ছে। ধলাচান তখন এসে কলাচানকে তার হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিল, দেখে মনে হলো কাজটা করে সে খুব মজা। পেয়েছে।
কালাচানও পরের সপ্তাহ শেষ হবার আগেই তার নিজের হাত ব্যবহার করা শিখে গেল। তখন হাত দিয়ে একে অন্যকে ঠেলাঠেলি করা কালাচান ধলাচানের মজার একটা খেলা হয়ে দাঁড়াল।
কয়েকদিনের মধ্যেই তারা বুঝে গেল যে তাদের রবোটিক হাত দিয়ে তারা ঠেলাঠেলি ছাড়াও আরও মজার কাজ করতে পারে। তারা ইচ্ছে করলে কিছু-একটা ধরতে পারে। তারা তখন হাতের কাছে যেটাই পেল সেটাকেই ধরা শুরু করল, সেটাকে নাড়াচাড়া করা শুরু করল। ভুল করে একটা ফড়িং তাদের কাছে এসে হাজির হওয়ার পর সেটাকে যখন কালাচান খপ করে ধরে ফেলল তখন তাকে দেখে মনে হলো সে বুঝি রাজ্য জয় করে ফেলেছে!
রতন তাদের জন্যে কয়েকটা সাদা কাগজ বিছিয়ে দিল, তারপর সেখানে নানা রঙের কয়েকটা সাইনপেন রেখে দিল। কালাচান ধলাচান তাদের হাত দিয়ে কলমগুলো ধরে ধরে দেখল কিন্তু এটা দিয়ে কী করা যায় সেটা তারা বুঝতে পারল না। রতন তখন তার নিজের হাত দিয়ে রঙিন কলমগুলো দিয়ে কাগজে কিছু আঁকাজোখা করল। কালাচান আর ধলাচান খুব মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখল। তারপর তারা নিজেরাই কলমগুলো ধরে কাগজে আঁকাজোখা শুরু করল। নানা রঙের দাগগুলো কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং ছাড়া আর কিছুই হলো না। কিন্তু তারপরেও তো সেটা সত্যিকার কাকের বাচ্চাদের নিজেদের হাতে আঁকা ছবি!
কালাচান এবং ধলাচানের আরো একটা বিষয়ে বেশ প্রতিভা আছে দেখা গেল। তাদের বাসায় ছোটো একটা ইলেকট্রিক অর্গান রেখে দেয়া হয়েছে। তারা সেটা বাজিয়ে নানা ধরনের শব্দ তৈরি করে। রতন খুব মনোযোগ দিয়ে সেটা শুনে বোঝার চেষ্টা করল এই শব্দগুলোর মাঝে কোনো সুর আছে কি না–কিন্তু সে কোনো সুর খুঁজে পেল না!
নানা অকাজে ব্যস্ত থাকার কারণে মানিকের অনেকদিন হলো রতনের বাসায় আসা হয়নি। কালাচান ধলাচানের কথা সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। তাই অনেকদিন পর এসে সে যখন দেখল টেবিলে একটা বড়ো কাগজ বিছানো এবং কালাচান আর ধলাচান দুজনে দুটো সাইনপেন দিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা ছবি আঁকছে তখন তার প্রায় একটা হার্ট এটাকের মতো অবস্থা হলো। সে তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করল, “এ-এ এরা কী করছে?”
“ছবি আঁকছে।”
“ছবি? কাকের বাচ্চারা ছবি আঁকতে পারে?”
রতন কালাচান ধলাচানের একটা ছবি হাতে ধরে বলল, “এটাকে যদি ছবি বলতে রাজি থাক।”
মানিক কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর সেই দৃষ্টিতে প্রথমে এক ধরনের বিস্ময় তারপর মুগ্ধতা নেমে এল। মানিক নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, “অসাধারণ!”
রতন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “অসাধারণ?”
“তুমি দেখছ না? মানুষের জীবনের ব্যর্থতা দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার কী অসাধারণ বিমূর্ত ছবি?”
“মানুষের? কালাচান ধলাচান এঁকেছে তাই এটা বড়োজোর কাকের জীবনের দুঃখ কষ্ট হতে পারে।”
মানিক খুবই বিরক্ত হলো, বলল, “সবকিছুকে সংকীর্ণ করে দেখা তোমার অভ্যাস। দৃষ্টিকে প্রসারিত কর। এই বিমূর্ত ছবির ভেতরকার সৌন্দর্য দেখার চেষ্টা কর।”
রতন দৃষ্টিকে প্রসারিত করে ছবির মাঝে শুধু কাকের ঠ্যাং আর বকের ঠ্যাংই দেখতে পেল। তাই মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে, তুমি যেহেতু এই ছবিতে সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছ, আমি এই ছবিটা তোমাকে বাঁধাই করে দিব, তুমি তোমার ড্রয়িংরুমে টানিয়ে রেখো।”
“ছবি বাঁধাই, কী বলছ? এই ছবির প্রদর্শনী করা সম্ভব। এই ছবি মিউজিয়ামে থাকা সম্ভব!”
রতন হাসি গোপন করে বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমি কাক পছন্দ কর না! তার আঁকা ছবি দেখে তুমি এত মুগ্ধ–“
মানিক মাথা নেড়ে বলল, “কাক সম্পর্কে আমার ধারণা সঠিক ছিল। আসলে কাকদের নিয়ে কবিরা কবিতা লিখেছেন। জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন হয়ত ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে জয়নুল আবেদিন তাঁর দুর্ভিক্ষের ছবিতে কাকদের স্কেচ এঁকেছেন। ঈশপ পর্যন্ত কাকদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গল্প লিখেছেন। এখন তুমি দেখালে কাকেরা শিল্পী!”
রতন বলল, “আমার কালাচান ধলাচান শেষ পর্যন্ত তোমার মনের মতো হয়েছে শুনে খুশি হলাম।”
মানিক বলল, “এখন এদের নিয়ে কী করবে? এদের নান্দনিক অনুভূতিকে আরো বিকশিত করা যায় কীভাবে?”
রতন বলল, “আসলে আমি ঠিক করেছি এদের হাতগুলো খুলে এখন এদের ছেড়ে দেব।”
মানিক আঁতকে উঠে বলল, “কী বলছ তুমি?”
“হ্যাঁ। ঠিকই বলেছি।”
“কেন?”
পাখিদের নিয়ে আমার একটা থিওরি ছিল, যে পাখিদের হাত থাকলে তারা নানারকম কাজ করতে পারত। আমার সেই থিওরিটা প্রমাণ হয়ে গেছে, কাজেই আমার কাজ শেষ। এখন কালাচান ধলাচানকে ছেড়ে দেবার সময় হয়েছে।”